ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশন এর প্রবীণতম সদস্য, চট্টগ্রাম আইন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, (নিউ চাক্তাই তদানিন্তন ন্যাশনাল স্টোর ও মেসার্স বাগদাদ রাইস, ফ্লাওয়ার এন্ড অয়েল মিলস এর স্বত্বাধিকারী মরহুম আলহাজ্ব হাফেজুর রহমানের ২য় সন্তান),পটিয়া বিনিনিহারা গ্রামের, কুসুমপুরা ইউনিয়নের কৃতি সন্তান, লালখান বাজার, হাই লেভেল রোডস্থ ‘হেলেন ভিউ’ নিবাসী আলহাজ্ব ব্যারিষ্টার আমিনুল হক (৮৬) গত ২০ই জুলাই ২০২২ইং বুধবার সকাল ১১.১৫ টায় নগরীর একটি হাসপাতালে আই.সি.ইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না লিল্লাইলাহে রাজেউন)। ঐদিন বুধবার বাদ জোহর লালখানবাজার হেলেন ভিউ হাই লেভেল রোডস্থ নিজ বাসভবন চত্বরে মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা ও বাদ আসর চট্টগ্রামের হযরত গরীবুল্লাহ্ শাহ্ মাজার মসজিদ প্রাঙ্গনে ২য় নামাজে জানাজা শেষে তৎ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁর বড় ভাই মরহুম আব্দুর রশিদ সওদাগর ও ছোট বোন আলহাজ্ব নূর বেগমের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি লাং ইনফেকশন, শ্বাসকষ্ট , ডায়বেটিস, কিডনী সহ নানা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শ্বশুর আব্বা হিসেবে এ হৃদয়বান মানুষকে অত্যন্ত কাছের থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ হয়েছে । বিশিষ্ট আইনবিদ মরহুম ব্যারিস্টার আমিনুল হক একজন বিনয়ী ভদ্র ও অমায়িক স্বভাবের ব্যক্তি ছিলেন। মানুষ হিসেবে খুবই সৎ এবং এক কথার লোক। আমার বাবা নাকি সৎ মানুষের মেয়ে খুঁজতে গিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করেন। আমার বিয়ের উকিল ছিলেন চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখক মরহুম আব্দুল হক চৌধুরীর পুত্র মরহুম এডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরী। আমার স্ত্রী মিসেস আশফা খানম মরহুম আমিনুল হক সাহেবের বড় মেয়ে। তিনিও একজন আদর্শ শিক্ষিকা। আমার শ্বশুর আব্বা পটিয়া উপজেলার বিনিনিহারা গ্রামে ১৯৪২ সালের ১৩ই জুলাই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে আইএ, ১৯৫৯ সালে গ্রাজুয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকবাল হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ১৯৬২ সালে এম এ, ১৯৬৩ সালে এলএল.বি ডিগ্রী অর্জন ও ১৯৬৪ সনের শেষের দিকে বার কাউন্সিল সনদ লাভে আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৬৪ সনে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন গমন করেন এবং ১৯৬৯ সনে বিলাতের লিংকন্স ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রী অর্জন করে ১৯৭১সালের শুরুতে দেশে ফিরে এসে মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়নে অজ্ঞাত স্থানে অনেকের সাথে তাঁকেও ধরে নিয়ে গেলে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে আল্লাহর রহমতে কৌশলে পরিচয় গোপন করে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনি সেদিন একমাত্র বেঁচে যাওয়া মানুষটি। গত বছর ২১শে ডিসেম্বর ২০২১ইং ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে বার এসোসিয়েশন অডিটরিয়ামে ২১/১২/২১ইং তারিখে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্নজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী, স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা প্রদান করা হয়। তিনি আন্দরকিল্লায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম আইন কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। ব্যারিস্টার হক লায়ন্স ক্লাব এর প্রাক্তন ডিস্ট্রিক্ট প্রেসিডেন্ট (১৯৮১-১৯৮২ইং) ছিলেন। তাঁর মাছ ধরার প্রতি শখ থাকার কারণে তিনি বি. রেলওয়ে ফিসিং এ্যাংলিং এন্ড সুটিং ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন। উনাদের মাছ ধরার একটা গ্রুপ ছিল, ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী, এডভোকেট সূনিতী হাজারী, এডভোকেট মুজিবুর রহমান, ব্যারিস্টার সাইফুদ্দীন মাহমুদ, এডভোকেট শামসুদ্দীন আহমদ মির্জা প্রমুখ সবাই মিলে একযোগে দল বেধেঁ মাছ শিকারে যেতেন। শুধুমাত্র মাছ শিকারের খাদ্য সামগ্রী তৈরীর জন্য বাসার ছাদে বড় একটা রুম তৈরী করেন। এখনও মাছ শিকারের সরঞ্জামাদি সব আগের মত যত্ন সহকারে রয়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। সফর পিপাসু মানুষটি ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ইটালী, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, বার্মা(মায়ানমার) সহ পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম আলহাজ্ব হাফিজুর রহমান তাঁর পিতা এবং মরহুমা আলমাছ খাতুন তাঁর মাতা। তাঁর পিতা মরহুম হাফিজুর রহমান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জমিদার, দানবীর ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তদানিন্তন সময়ে চাক্তাই এর ‘ন্যাশনাল ষ্টোর’ ও সুপরিচিত ‘মেসার্স বাগদাদ রাইস’ ফ্লাওয়ার এন্ড অয়েল মিলস্ এর স্বত্বাধিকারী ছিলেন। এছাড়া তিনি তদানিন্তন বার্মার (মায়ানমার) রেংগুনে ব্যবসা করতেন। ব্যারিস্টার হক লালখান বাজারের স্থায়ী বাসিন্দা। পটিয়া বিনিনিহারা গ্রামে আমার দাদা শ্বশুর প্রখ্যাত জমিদার ও ব্যবসায়ী মরহুম হাজী হাফিজুর রহমানের দ্বিতল সুন্দর বাড়ীটি ১৯৬৪ সানে নির্মিত হয়। পাড়াটি দেখে মনে হলো এক সময় তারা ব্যবসা বানিজ্য ও শিক্ষা দীক্ষায় চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিত। চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল আমার দাদা শ্বশুর মরহুম হাজী হাফেজুর রহমান এর ৪ ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক প্রিন্সিপ্যাল মরহুম আব্দুস সবুর আমার শ্বশুরের কাজিন হয়। আমার দাদা শ্বশুরের বাবার নাম মরহুম আমছুর আলী । আমার দাদা শ্বশুররা ৪ ভাই এর যৌথ ব্যবসা ছিল । নিউ চাক্তাই ন্যাশন্যাল ষ্টোর, আয়রন ও স্টিল আমদানীকারক, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল । তাদের প্রচুর ধন সম্পত্তি ও জমিজমা ছিল । ব্যবসা বাণিজ্যে তাদের বহু পুরোনো ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। এক সময় কলকাতায় এবং বার্মার (বর্তমানে মায়ানমারে) আকিয়াবে তাদের ব্যবসা ছিল। আমার শ্বাশুড়ী আম্মা থেকে শুনেছি তাদের দোকানে স্বর্ণ থেকে ফুলের ঝাড়– পর্যন্ত সব পাওয়া যেত। যা আধুনিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতেও পাওয়া যায় না। আমার দাদা শ্বশুর হাজী হাফেজুর রহমান হিজবুল বাহার নামক জাহাজে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। তাঁর অপর ৩ ভাই যথাক্রমে হাজী আলী আব্বাস, হাজী ওছিয়র রহমান, হাজী আনিসুর রহমান প্রমুখের যৌথ পরিবার ও ব্যবসায় সাফল্য এখনও মানুষের মুখে মুখে। চাক্তাই খাতুন গঞ্জের বেশিরভাগ দোকান তাদের ছিল। তদানিন্তন সময়ে তাদের ৪ ভাইয়ের ৪ টি প্রাইভেট কার ছিল। ১৬টি পাল তোলা মালবাহী জাহাজ ছিল (জালী বোট নামে পরিচিত)। ব্যারিস্টার সাহেবদের উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত চাক্তাই এর পুরানো ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং ‘না-খোন্দা’ বিল্ডিংটি তাঁর বাবারা ৪ ভাই মারোয়ারীদের থেকে কিনে নিয়েছিলেন। তাঁর বড় ভাই মরহুম আব্দুর রশিদ (প্রকাশ কালু সওদাগর) মেহেদীবাগ সিডিএ মসজিদের পাশে পাখিওয়ালা বিল্ডিং এর মালিক ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। কিছুদিন আগে তাঁর ছোট ভাই হাজী নুরুল আমিন মারা যান । এখন সবার ছোট ১ বোন শাহজাহান বেগম বেঁচে আছেন। বর্তমানে তাদের জমিদারী ও ব্যবসা পৃথক হয়ে গেছে। তিনি আইন পোশার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম আইন কলেজেও শিক্ষকতা করেন। তিনি এক পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রী মিসেস আলহাজ্ব মালেকা পারভীন গত ২০১৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী আকষ্মিকভাবে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি কোতোয়ালী থানাধীন পাথরঘাটা এলাকার প্রখ্যাত জমিদার তদানিন্তন ২২ মহল্লা সরদার ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সূফী আলহাজ্ব আব্দুস সোবাহান সওদাগরের কনিষ্টা কন্যা আলহাজ্ব গুলশান আরা বেগম এর কন্যা। ব্যারিষ্টার আমিনুল হক এর শ্বশুর পাথরঘাটা ও আনোয়ারা উপজেলার সরেঙ্গা গ্রামের আলহাজ্ব সৈয়দ আহমদ চৌধুরী বি.এল (ব্যাচলর অব ল) একজন নামজাদা ব্যবসায়ী, দানশীল ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। ব্যারিষ্টার আমিনুল হক ও মিসেস আমিনুল হক এর চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে আশ্ফা খানম হেলেন এম.এস.সি (রসায়ন), বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল (ন্যাশনাল ক্যারিকুলাম) চিটাগাং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল-সিভিএনএস এর অধ্যক্ষ। ২য় কন্যা ফাহমিদা খানম মুনমুন অর্থনীতিতে মাষ্টার্স ডিগ্রিধারী ও নগরের একটি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের টিচার তার স্বামী- ওয়াসিফ শান্তনু রশিদ মুক্তি, মরহুম এম এ আজীজ এর ছোট ভাই মরহুম এম এ মজিদের ছোট ছেলে । ৩য় কন্যা তাহমীনা খানম বি.এস.এস অনার্স (Sociology)। তাঁর স্বামী হামদান কাশেম চৌধুরী একজন হিউম্যান ট্রেইনার ও লীড ইনস্টিটিউশনের পরিচালক ।৪র্থ কন্যা ডাঃ আসমা খানম এম.বি.বি.এস বর্তমানে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল অফিসার। তাঁর স্বামী কফিল উদ্দিন চৌধুরী (জুয়েল) গ্রামীন ফোনে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা । একমাত্র পুত্র তানভীরুল হক ঢাকাস্থ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইয়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রেজুয়েশন করেন এবং বর্তমানে একজন সফল ব্যবসায়ী । তাঁর স্ত্রী জারাহ্ জুবায়ের ও একজন সফল নারী উদ্যোক্তা । মরহুম হক নাতি নাতনীদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পকেটে সব সময় ছোটদের জন্য চকলেট কিনে রাখতেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তিনি নাতী নাতনীদের পুরস্কৃত করতেন। তাঁর খুব ইচ্ছে তাঁর নাতি নাতনিরা জীবনে আদর্শ মানুষ হোক। মেহমানদারিতে তিনি ছিলেন অতুলনীয় । মেহমানদের আগে তাদের ড্রাইভার ও কাজের লোকদের মেহমানদারি করা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা অভ্যাস ছিল । তিনি নিজ এলাকায় একটি গণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়াও রাউজান আর্যমৈত্রেয় ইনিস্টিটিউশন সহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিপুল অনুদান প্রদান করেন । তিনি বহু গরীব আত্মীয় স্বজনকে স্বনির্ভর হতে নানাভাবে সহায়তা করেন । তিনি ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার সমিতির প্রবীণতম জীবিত সদস্য ছিলেন। বয়োবৃদ্ধ বটবৃক্ষ সমতুল্য এই পরম অভিভাবক ও মুরুব্বীকে হারিয়েছি আমরা। তিনি সবসময় আমাকে চেম্বারে দেখে যেতেন এবং দোয়া দিয়ে যেতেন। তাঁর স্নেহের ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না। আল্লাহ পাক রহমান রহিম তাঁকে মেহেরবানি করে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন আমিন।
লেখকঃ আইনবিদ, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকারকর্মী।