জিয়া হাবীব আহ্সান:
পিতা মাতার প্রতি সন্তানের রক্ত ঋণ কখনো শোধরানোর মতো নয়। আনুগত্য ও সেবার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের মাধ্যমে এ ঋণ শোধের কিছু চেষ্টা করা হয় মাত্র। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের অবজ্ঞা অবহেলায় নিদারুণ দুঃখ কষ্টে দিন কাটাতে হয় অনেক অসহায় পিতা মাতাকে । অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে কিংবা অবহেলা অযত্নে চরম মানবেতর জীবন যাপন করতে দেখা যায়। পবিত্র ইসলাম ধর্ম জন্মদাতা মাতা-পিতাকে স্রষ্টা ও মহানবী (সঃ) এর পরে স্থান দিয়েছে । মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত । হাদীসে উল্লেখ আছে, পিতা মাতা যদি দুর্বল, বৃদ্ধ ও সন্তানের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে তবে এই অবস্থায় তাঁদের সাহচর্য দেয়া ও শুশ্রূষা করা হিজরতের মতো উত্তম আমলের চেয়েও অধিক উত্তম । মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) পিতা মাতার মৃত্যুর পরও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার ৪টি উপায়ের কথা উল্লেখ করেন। যথা : (ক) তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা (খ) তাদের কৃত ওয়াদা পূর্ণ করা (গ) তাদের বন্ধু-বান্ধব ও অন্তরঙ্গ ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করা এবং (ঘ) তাদের মাধ্যমে সন্তানদের আত্মীয়তার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে (অর্থাৎ-চাচা, ফুফু, মামা, খালার মত আত্মীয়দের সাথে সু-সম্পর্ক) তা অক্ষুণ্ণ রাখা । ইসলামে পিতা-মাতার অবাধ্য আচরণ সব চাইতে মারাত্মক কবীরা গুনাহ্, যা আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশ অমান্যকারীর সমতুল্য । পিতা মাতার সাথে সর্বোত্তম আচরণ করা, বিনয়, সম্মান ও দরদের সাথে কথা বলতে হবে । তাদের সাথে কখনো অসম্মান ও বিরক্তিসূচক উহ্ শব্দও করা যাবে না । প্রকৃতপক্ষে পিতা-মাতাকে খেদমতের সুযোগ পেয়েও যারা জান্নাতে যেতে পারে না তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেহ হতে পারে না । শিশু কিশোর অবস্থায় হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগরের মাতৃভক্তির কাহিনী সকলের মুখে মুখে । প্রত্যেক ধর্মেই মা-বাবার সম্মান ও মর্যাদা সর্বাগ্রে, হিন্দুদের তীর্থস্থান ভারতে কাশীতে একটি মন্দির আছে, গঙ্গা নদীর তীরে । কথিত আছে এক সন্তান মন্দিরটি নির্মাণ করে অহংকার করে বলেছিলেন, আমার মাতৃ-পিতৃ ঋণশোধ করলাম । সাথে সাথে মন্দিরটি গঙ্গা নদীর দিকে হেলে পড়লো । আজও মন্দিরটি একই অবস্থায় আছে বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী শ্রদ্ধেয় এডভোকেট সুনীল কুমার সরকার এর মুখে শুনেছি । মনীষী স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “সেই সন্তানেরাই ধন্য, যাহারা তাহাদের পিতা-মাতাকে ভগবানের প্রকাশ রূপে দেখিতে সমর্থ হয়।” মা-বাবা কঠোর, ক্লেশ, দুঃখ কী সহ্য করে সন্তানকে বুকে আগলে রেখে মানুষ করেন । নিজের আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের সার্বক্ষণিক মঙ্গল চিন্তা করেন । সেই মা-বাবার প্রতি সন্তানের বিরূপ আচরণ কোনো মতেই প্রশ্রয় দেয়া যায় না । পিতা – মাতার সেবা করা প্রত্যেক পরিবারে বসবাস প্রথার পরিবর্তন হয়েছে। ক্রমেই মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এতে দিন দিন ভেঙে পড়ছে দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসা যৌথ পরিবার। সন্তানরা ভুলে যাচ্ছে মা-বাবার মায়ার বাঁধন। সন্তানের অবহেলায় নিগৃহীত মা-বাবার দুঃখ কষ্ট লাঘবে ও তাদের অধিকারকে আইনী স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৩ সনের ৪৯নং আইন বা মা-বাবার ভরণ পোষণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনে পিতা-মাতা, দাদা-দাদি এবং নানা-নানির ভরণ-পোষণ করা সন্তানের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব । অন্যথায় তাদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে । নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো । পিতা–মাতা জীবনের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু বর্তমানে বৃদ্ধ পিতা-মাতার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। এমন অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস হয় পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন, যা পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক করা হয় । সংসদ কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রণীত আইনটি বর্তমানে কার্যকর । এই আইনে পিতা বলতে সন্তানের জনক এবং মাতা বলতে সন্তানের গর্ভধারিনীকে বুঝানো হয়েছে । আর সন্তান বলতে পিতার ঔরষে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেয়া সক্ষম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যাকে বুঝানো হয়েছে । এ আইনে ভরণ-পোষণ অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গপ্রদানকে বুঝায়। উক্ত আইনের ৩ ধারার বিধান মতে প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা- মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। তবে একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে সন্তান নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবেন। উপধারা ৩ এর বিধানমতে এক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোন সন্তান তার পিতা-মাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথা একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না । প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে । সঙ্গত কারণে যদি পিতা বা মাতা বা উভয় থেকে সন্তানকে পৃথকভাবে বসবাস করতে হয় সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তার বা তাদের সাথে সাক্ষাত করতে হবে। কোন পিতা-মাতা সন্তানের সাথে বসবাস না করে পৃথক বসবাস করলে ক্ষেত্র বিশেষে প্রত্যেক তাদের দৈনিক / মাসিক / বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ তাদের প্রদান করবে। দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ পোষণঃ উক্ত আইনের ৪ ধারার বিধানমতে প্রত্যেক সন্তান তাদের পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ৩ ধারার বিধান অনুসরণে মা-বাবার মতোই ভরণ পোষণ প্রদানে বাধ্য থাকবে। এই ভরণ পোষণ পিতা-মাতার ভরণ পোষণ হিসেবে গণ্য হবে । পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, যদি কোনো প্রবীণ তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে । ৬ ধারার বিধানমতে পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইনটি আমলযোগ্য (cognizable) । জামিনযোগ্য (Bailable) ও আপৌষযোগ্য (compoundable) হয়। এই আইনে অপরাধের বিচার ১ম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারযোগ্য। উক্ত স্লাইনের অধীনে অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আদালত তা আমলে নেবেন না । আদালত ৮ ধারার বিধানমতে প্রাপ্ত অভিযোগটি আপোষ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউ.পি চেয়ারম্যান বা মেম্বার, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর বা অন্য যে কোন উপযুক্ত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করতে পারবেন । আপোষ নিষ্পত্তির জন্য প্রেরিত অভিযোগ আদালত কর্তৃক দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি উভয়পক্ষকে শুনানীর সুযোগ দিয়ে আপোষে নিষ্পত্তি করবেন এবং এরূপ নিষ্পত্তি আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি মর্মে গণ্য হবে। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না দেয়ার দণ্ড বা শান্তি ও এ আইনের ৫ ধারার বিধানমতে কোন সন্তান কর্তৃক উক্ত আইনের ৩ ও ৪ ধারার বিধান লংঘন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উক্ত অর্থদণ্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে ৩ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে । কোন সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী কিংবা তাদের পুত্র-কন্যা (নাতি-নাতনি) বা অন্য কোন নিকটাত্মীয় পিতা-মাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করলে অসহযোগিতা করলে বা না দেয়ার জন্য প্ররোচিত করলে তিনিও উক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন । ষাটোর্ধ্বদের সিনিয়র সিটিজেন বলা হয়। ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর বিশ্ব প্রবীণ দিবসে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ নাগরিককে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। পরিশেষে বলা যায়, শুধুমাত্র আইন দিয়ে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অমানবিক আচরণ ও দায়িত্বহীনতার অপরাধ রোধ করা সম্ভব নয় । এজন্যে প্রয়োজন ধর্মীয় অনুভূতি, মৃত্যু চিন্তা, শেষ বিচারের ভয়, বিবেকবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করা । বিশেষ করে এক্ষেত্রে আমাদের সমাজে প্রচলিত অথচ ক্ষয়িষ্ণু পারিবারিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে । যারা মা-বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে না। তাদেরকে সামাজিকভাবেও বয়কট করা যেতে পারে । নাটক, সিনেমা, গান, গল্প উপন্যাসে মা- বাবাবিহীন স্বামী স্ত্রীর টোনা-টুনির জীবন কাহিনীর বিপরীতে মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব বান্ধব একটি সমাজ গঠনে দায়িত্বশীল ভূমিকা উপস্থাপন এ অপরাধ নির্মূল করতে সহায়ক হবে। আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের মতো প্রবীণ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মানিত করার জন্যও বিশেষ আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে । আসুন আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজ নিজ পিতা-মাতা ও তাদের অবর্তমানে নানা-নানী, দাদা-দাদীর প্রতি সম্ভাব্য সকল প্রকার সহানুভূতি ভালবাসা ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে অবদান রাখি। এতে আমাদের সন্তানরাও আমাদের প্রতি দায়িত্বশীল হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সিনিয়র সিটিজেনদের মর্যাদা, সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষায় আইনটিকে আরো সংশোধন ও যুগোপযোগী করা দরকার । আল্লাহ্ সুবহানুতায়ালা আমাদের তৌফিক দিন, আমীন।
লেখকঃ এডভোকেট, মানবাধিকার সুশাসনকর্মী ও কলামিস্ট।