যে ভাইকে বাবার স্নেহ দিয়ে বড় করেছি; সেই আমার সন্তানকে হত্যা করল? সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার সন্তানকে না মেরে আমাকে মারতো, তার কি এমন দোষ ছিল? শুধু কি আমার ছেলেই তোর মেয়েকে ভালোবেসেছে, তোর মেয়েকি ভালোবাসে নাই। যদি তোর মেয়ে ভালো নায়েই বাসতো তাহলে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় গিয়ে কেন আমার ছেলেকে বিয়ে করল?
এসব বলতে বলতে রোববার (২ জুন) রাতে কোতোয়ালী মডেল থানার একটি কক্ষে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন নিহত ওমর ফারুক সৌরভের বাবা ইউসুফ আলী।
ওমর ফারুক সৌরভের বাবা ইউসুফ আলী বলেন, ইলিয়াস আলী আমার ছোট ভাই; আর ভাইদের মধ্যে তাকেই আমি বাবার স্নেহ দিয়ে বড় করেছি। আজকে আমার ছেলেকে চারখণ্ডে হত্যা করে প্রতিদান দিয়েছে। ৪—৫ বছর ইশরাত জাহান ইভার সঙ্গে প্রেমের পর গত ১২ মে তাকে বিয়ে করে। সে বিয়ে আমিও মেনে নেয়নি; কিন্তু ছেলে—মেয়েরা তো ভুল করতেই পারে? বিয়ের পরপরেই ইলিয়াস বিভিন্ন সময় আমাদেরকে কল করে হত্যার হুমকি দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ১৬ মে নিজের মেয়েকে কানাডায় পাঠিয়ে দিয়ে সৌরভকে হত্যার ছক আঁকে। এরই অংশ হিসেবে শনিবার সৌরভকে কৌশলে ঢেকে ময়মনসিংহে আনেন, সৌরভ আমাদের কিছু না বলেই চলে আসে। পরে ওই দিন রাতে শুনতে পাই সে ময়মনসিংহে। কিন্তু রাত ১১টার পর যখন সৌরভের মোবাইল বন্ধ পাই; তখন থেকেই চিন্তা হচ্ছিল। পরে সকালে শুনি মনতলা ব্রিজের নিচে সৌরভের চারখণ্ড মরদেহ পাওয়া গেছে; কেন আমার ছেলেটাকে এভাবে হত্যা করল?
শুধু ইউসুফ আলী নয় একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তার মা মাহমুদা আক্তার পারুল যেন কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ভালোবেসে চাচাতো বোনকে বিয়ে করাই আমার ছেলের কাল হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনোদিন ভাবেনি যে আপন চাচা তার ভাতিজাকে এভাবে হত্যা করবে? এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়েই আমার সাজানো সংসার ছিল। ইলিয়াস সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। আমার সন্তানকে যেভাবে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে আমিও তার সেভাবে মৃত্যু চাই।
নিহত সৌরভের বোন মারুফা আক্তার পপি বলেন, ইশরাত জাহান ইভা আমার ভাই সৌরভের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি আরেকজনের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে ছিল। সেই ছেলের বাবা একজন চিকিৎসক, তার নাম আমিনুল ইসলাম। তবে ইভা গত ১২ মে আমার ভাইকে বিয়েও করে, সে বিয়ে তার পরিবার মেনে না নিয়ে তাকে কানাডায় পাঠিয়ে দেয়। সৌরভ বিয়ের বিষয়টি চিকিৎসক আমিনুল ইসলামকে জানাতে শনিবার ময়মনসিংহে আসে। পরে আমার চাচা সৌরভকে কল দিয়ে গোহাইলকান্দি তাদের বাসায় নিয়ে যায়; এরপর রাতে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।
সৌরভের সহপাঠী রবি সান বলেন, সৌরভ প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা সবসময় এক সঙ্গে চলাফেরা করতাম। সৌরভ ইভার প্রেমের সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের; গত কয়েকদিন আগে তারা বিয়েও করে। শনিবার সে ময়মনসিংহ এসেছে আমি তা জানতাম, কিন্তু ওইদিন রাত ১১টার পর থেকে তার মোবাইল বন্ধ ছিল। পরে সকালে শুনি সৌরভকে হত্যা করা হয়েছে; আসলে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা হত্যাকারীর বিচার চাই।
এদিকে, রোববার রাতে অজ্ঞাতদের আসামি করে কোতোয়ালি মডেল থানায় নিহতের বাবা ইউসুফ আলী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে; যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পারিবারিক বিরোধের কারণেই সৌরভ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, রোববার দুপুরে ওমর ফারুক সৌরভের চার খণ্ডিত মরদেহ সদর উপজেলার মনতলা ব্রিজের সুতিয়া নদী থেকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে গাঁ ঢাকা দিয়েছেন ইলিয়াস আলীর পুরো পরিবার। ইলিয়াস আলী ময়মনসিংহ নগরীর গোহাইলকান্দি একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি সেনবাহিনীর নায়েক পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন। আর ইউসুফ আলী পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। তিনি ডাক বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারাটি এলাকায়।