ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্নস্থানে অগ্নিকাণ্ড এবং হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একদল উগ্রপন্থী এ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে বর্ণনা করে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানে এমন কিছু চিত্র উঠে এসেছে যাতে বলা হয়েছে, উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশে ‘হিন্দুদের গণহত্যা’ করা হচ্ছে এমন অনেক ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে মানুষের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি করতে চেয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া ভিডিও গুলোর কোনোটিতে আগুনে বাড়িঘর জ্বলছে, কোনোটিতে ভয়ানক সহিংসতা, কোনোটিতে আবার সহায়তা চেয়ে নারীদের ক্রন্দনের দৃশ্য।
যারা এই ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে স্টিফেন অ্যাক্সলে–লেনন একজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টমি রবিনসন নাম ব্যবহার করে এমন প্রচারণা চালানো অ্যাক্সলে–লেনন ব্রিটিশ উগ্রপন্থী কর্মী। যুক্তরাজ্যে সংঘটিত দাঙ্গার সময় উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পোস্ট দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে ভুয়া ভিডিও ছড়ানোয় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি যোগ দিয়েছেন। সতর্কবার্তাও থাকছে তাঁর ভিডিওতে।
সংখ্যালঘুদের ওপর মুসলিমদের হামলার দাবিসংবলিত বেশ কিছু ভিডিওর সত্য–মিথ্যা যাচাই করেছেন বিবিসির গ্লোবাল ডিস–ইনফরমেশন টিমের জ্যাকি ওয়েকফিল্ড ও বিবিসি ভেরিফাইয়ের শ্রুতি মেনন। তারা দেখেছেন, অনলাইনে এ নিয়ে ছড়ানো অনেক ভিডিও ও দাবিই ভুয়া।
শেখ হাসিনার পতনের পর সহিংসতা ও লুটের প্রভাব পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ও সম্পত্তির ওপরও। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতে উগ্রপন্থী ইনফ্লুয়েন্সাররা এ নিয়ে ভুয়া ভিডিও ও তথ্য ছড়িয়েছেন। এতে প্রকৃত ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া এক পোস্টে একটি মন্দিরের ছবিজুড়ে দাবি করা হয়, এটিতে আগুন দিয়েছেন ‘বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা’। কিন্তু ‘বিবিসি ভেরিফাই’য়ে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে অবস্থিত নবগ্রহ মন্দিরটি সহিংসতাচলাকালে অক্ষত ছিল। প্রকৃতপক্ষে আগুন জ্বলছিল কাছাকাছি থাকা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে। যেটিকে মন্দির বলে চালিয়ে দেয়া হয়।
ওই মন্দিরের কর্মী স্বপন দাশ বিবিসি ভেরিফাইকে বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুরের পর এ মন্দিরের পেছনে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা হয়। হামলাকারীরা কার্যালয়ের ভেতর থেকে আসবাবপত্র বাইরে এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন।’
তিনি আরও বলেন, ওইদিন মন্দিরে হামলা না হলেও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলি। মন্দির রক্ষায় স্থানীয় লোকজন দিন–রাত পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নজর রাখা প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ডওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, হিন্দুদের বাড়িঘর–মন্দিরে মুসলিমদের হামলা—গত ৪ আগস্টের পর থেকে এমন হ্যাশট্যাগের অধীন প্রচারণায় লাখ লাখ মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এ ধরনের প্রচারণা চালানো হয়েছে, সেসবের অধিকাংশ ভারতীয় অ্যাকাউন্ট।
ভাইরাল হওয়া পোস্টে বাংলাদেশি একজন হিন্দু ক্রিকেটারের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই ঘটনা লিটস দাসের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হলেও বাড়িটি ছিল মাশরাফি বিন মর্তুজার।
হামলা–আগুনসংক্রান্ত এসব পোস্টের সবই কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টের অনেকগুলো হিন্দু জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধকে সমর্থন করে।
বাংলাদেশ–ভারতের বাইরে থেকেও অপপ্রচার
শেখ হাসিনার পতনের পর হিন্দুদের ওপর সহিংসতার যে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে তা বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও অন্যান্য প্রান্ত থেকে করা হয়েছে।
এমন অ্যাকাউন্টধারীদের একজন টমি রবিনসন। যুক্তরাজ্যে মুসলিম ও অভিবাসীদের লক্ষ্য করে পরিচালিত দাঙ্গায় উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে যাচাই না করা ভিডিও শেয়ার করছেন তিনিও। ভিডিওতে তিনি বলেছেন, ‘সেখানে (বাংলাদেশে) হিন্দুদের বিরুদ্ধে গণহত্যা’ চলছে।’
বাংলাদেশে এএফপির ফ্যাক্ট–চেকার কদরউদ্দীন শিশির বিবিসিকে বলেন, হিন্দুদের মালিকানাধীন বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। কিন্তু ডানপন্থী ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব হামলাকেই ধর্মীয় কারণে হামলা বলে প্রচারণা চালাচ্ছে।
এদিকে হিন্দুদের ওপর হামলা নিয়ে যখন অনলাইনে মিথ্যা দাবি ছড়ানো হচ্ছে, ঠিক তখন কিছু মুসলিম বিক্ষোভকারী মন্দিরগুলো পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।