যশোরে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ সমর্থিত বেশিরভাগ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে এসেছেন। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত পর তারা নিজ নিজ দপ্তরে গেলে বিক্ষুব্ধ লোকজন বাঁধা দেয়। লাঞ্চিত করা হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের।
রোববার (১৮ আগস্ট) সকালে থেকেই দপ্তরের সামনে লাঁঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। কোথাও কোথাও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে দপ্তর। লুট করা হয়েছে জনপ্রতিনিধিদের হাজিরাবইসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিও। এসব ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের দায়ী করে নিরাপত্তার দাবিতে জেলা প্রশাসক ও নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী জনপ্রতিনিধি। তবে অভিযোগ মিথ্যা দাবি জেলা বিএনপির। আর প্রশাসন বলছেন, বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।
জানা গেছে, যশোরে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় এই চার স্তরে ১ হাজার ৩২৩ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে ৯১টি ইউনিয়নে ৯১জন চেয়ারম্যানসহ ১ হাজার ১৮৩ জন, ৮টি উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান ও ২ জন করে ভাইস চেয়ারম্যান মিলে ২৪ জন, ৮টি পৌরসভায় ১০৪ জন এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ ১২ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জেলার আট উপজেলাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করে জয়ী মেয়র, কাউন্সিলর ও উপজেলা চেয়ারম্যানরা চলে যান আত্মগোপনে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন সেবা নিতে আসা নাগরিকরা। এরপর জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্বে না ফিরলে বরখাস্ত হবে এমন সিদ্ধান্তের পর থেকে অধিকাংশ চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর, মেম্বররা নিজ নিজ দপ্তরে যান। দপ্তরে যেয়ে কেউ লাঞ্চিত, মারধরের শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ বিএনপি নেতাদের অবস্থান, কার্যালয়ে হামলা ঘটনা শুনে দপ্তরে যাননি।
জানা গেছে, রোববার সকালে শহরের কাজিপাড়া থেকে গাড়িতে করে সদর উপজেলা পরিষদে যাচ্ছিলেন চেয়ারম্যান তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। যাওয়ার পথে তিনি জানতে পারেন উপজেলা পরিষদ কার্যালয় তালা মেরে দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা উপজেলা চত্বরে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান করছেন। এমন অবস্থায় তিনি আর দপ্তরে যাননি। পরে দুপুরে বিএনপির নেতাকর্মীরা সদর উপজেলা কার্যালয় ভাঙচুর করেছে। এই ঘটনায় জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ফন্টু চাকলাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই। তিনি জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অফিসে যেতে পারেননি। অফিসে যাওয়ার পথে শুনি সন্ত্রাসীরা অফিসের নিচে অবস্থান ও হামলা চালিয়েছে। ফলে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকাতে আমি আর অফিসে যায়নি। নিয়মিত অফিস যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ও যতযত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিযোগ দিয়েছি।
তিনি জানান, আমরা পৌরসভাতে নিয়মিত কার্যক্রম করছিলাম। এমন সময় স্লোগান দিতে দিতে বিএনপির নেতাকর্মীরা পৌরসভাতে হামলা করে। এ সময় কয়েকজন কর্মকর্তাকে লাঞ্চিত করে ও বের করে দেয়। হাজিরা খাতা ও গুরুত্বপূর্ণ নথি তারা নিয়ে যায়।
এছাড়া যশোর পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধা হায়দার গণি খান পলাশ পৌরভবনে গেলে সেখানে আগে থেকে অবস্থান নেয়া বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে লাঞ্চিত করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। লাঞ্চিত হয়ে নেতাকর্মীদের তোপের মুখে তিনি আর দপ্তরে অফিস করতে পারেনি। এই বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান লাইফ বলেন, ৫ আগস্টের পর একদিন মাত্র অফিসে গেছি। বিএনপি নেতাকর্মীদের হুমকিতে যেতে পারছি না। সকাল ১০টার দিকে ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক ডা. আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে অবস্থান নেয় ইউপি কার্যালয়ে। একপর্যায়ে সকল মেম্বরদের তিনি বের করে দেন। কাউকে অফিস করতে দেবেন না বলে তিনি জানান।
জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে হামলা ও জনপ্রতিনিধিদের লাঞ্চনার অভিযোগ উঠেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আর মুঠোফোনে জনপ্রতিনিধিদের দপ্তরে না যাওয়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে বলে জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুতের পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিএনপি নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্ভয়ে ঘরে ফেরার আহ্বান জেলা বিএনপি। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ওসব জনপ্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে এসে নিজ নিজ দপ্তরে যাওয়াতে হামলার শিকার হওয়াতে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে দলের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে, প্রতিপক্ষ রাজনীতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা না করার। সেইভাবে আমরা নেতাকর্মীদের জানিয়ে দিয়েছি। বাধা দেয়া হামলা করার কোন নির্দেশনা দেয়নি আমরা। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা। সরকার যতদিন তাদের রাখবে, তারা ততদিন জনপ্রতিনিধি। আমাদের কোন নেতাকর্মী তাদের বাঁধা দেবে না।।
যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার জানান, জনপ্রতিনিধিদের বাঁধা দেয়ার ঘটনা দুঃখজনক। অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জানাবো।