নেতিবাচক মানসিকতা একটি সমাজে কারো কারো থাকতে পারে, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন সমাজের বেশির ভাগ মানুষই একই রকম হয়ে যায়। যেমনটি এবার হয়েছে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। নেতিবাচক মানসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে অভিনন্দন বার্তার পরিবর্তে আমাদের ভবিষ্যেক ছোট করা হয়েছে ‘অটোপাশ’ বলে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার—১১টি বোর্ডের ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন পরীক্ষার্থীকে আমরা বলছি পরীক্ষা ছাড়াই পাশ।
করোনার এমন জটিল পরিস্থিতিতে ১০ মাস পর যখন ফল প্রকাশিত হয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার অবসান করা হলো—তখন অধিকাংশ গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে ‘অটোপাশ’, ‘পরীক্ষা ছাড়াই পাশ’, ‘সবাই পাশ’—এমন তির্যক শব্দ ব্যবহার করে। আমরা কি একবারও ভেবেছি এমন শব্দ ব্যবহার শিক্ষার্থীর মনের অবস্থাকে কতোটা বিষণ্ন করতে পারে? ২০২০ সালে যারা এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এসব শিক্ষার্থীকে ঐ বছরের ১ এপ্রিল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে বসার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হওয়ার মাত্র ১৩ দিন আগে ১৭ মার্চ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় করোনার ভাইরাস থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের রক্ষা করার জন্য। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কারণে বড় ধরনের সংকটে পড়ে যায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কারণ পরীক্ষার চেয়ে জীবন অনেক বড়।
ভাবা যায় এসব পরীক্ষার্থী যাদের বয়স এখনো ১৮/১৯ এর মধ্যে—তারা প্রত্যেকটি দিন কীভাবে কাটিয়েছে? কারণ সরকার বা মন্ত্রণালয় বারবারই সময় পিছিয়েছে। সব প্রস্তুতি থাকার পড়েও করোনার জন্য সম্ভবই হচ্ছিল না পরীক্ষা নেওয়া। পরীক্ষাহীন সময়গুলো কতোটা কষ্টে গেছে তা এসব পরীক্ষার্থীই ভালো বলতে পারবেন। এই সময় আমরা তাদের কষ্টের কথা কেউ শুনতে চাইনি, তাদের নিয়ে ভাবারও সময় পাইনি—কারণ করোনার ভয়েই অস্থির পুরো বিশ্ব। সরকারের সিদ্ধান্তে যখন সব শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির পথে ঠিক তখনই এসব শিক্ষার্থীর জন্য বর্জনীয় শব্দ ‘অটোপাশে’র তকমা লাগিয়ে দেওয়া হলো।
অথচ পরীক্ষা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত খোদ মন্ত্রণালয়ের। ৭ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংবাদ সম্মেলনে সবাইকে জানিয়ে দিলেন, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের গড় করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে। এক্ষেত্রে জেএসসির ২৫ শতাংশ এবং এসএসসির ৭৫ শতাংশ ধরে বিষয়ভিত্তিক গড় নম্বর তৈরি করে ফল প্রকাশ করা হবে। যারা বিভাগ পরিবর্তন করেছেন তাদের ক্ষেত্রে নম্বর বণ্টনের নানা উপায় খুঁজে বের করলেন আট সদস্যের গ্রেড মূল্যায়ন টেকনিক্যাল কমিটি। এই কমিটিতে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিসহ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা। সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পরীক্ষা বাতিল করা হলো।
জাতীয় সংসদে সাধারণ বোর্ড, কারিগরি বোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডের আইন সংস্কার করে ঘোষণা করা হলো পরীক্ষার ফল। আর এর পরই ‘অটোপাশ’, ‘অটো পাশ’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো পাড়া মহল্লা, টেলিভিশনের পর্দা, পত্রিকার পাতা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অনুসন্ধান করার মতো হাজারো ঘটনা বাদ দিয়ে কোনো কোনো গণমাধ্যম ‘পরীক্ষা ছাড়াই’ আরো কে কে পাশ করল এমন অনুসন্ধান শুরু করল। শুধু ২০২০ সালের পরীক্ষার্থীরাই নয়, যারা ২০১৯ সালে এইচএসসিতে ফেল করেছিল তারাও যে পাশ করে যাচ্ছে সেই আক্ষেপ ফুটে উঠেছে অনেক প্রতিবেদনে। নিয়মিত পরীক্ষার্থীর সঙ্গে আগের বছরের এক বিষয়, দুই বিষয় এবং তিন বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থী, অনিয়মিত শিক্ষার্থী, প্রাইভেট শিক্ষার্থীসহ এমন প্রায় ৩ লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষা না দিয়েই যে পাশ করে যাচ্ছে—এমন মহা ‘অন্যায়’ এর বিশ্লেষণ করেছে একাধিক গণমাধ্যম। অথচ নানা অপকর্ম আর দুর্নীতিতে তলিয়ে থাকা এ দেশে অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে হাজারো প্রতিবেদন করা সম্ভব কিন্তু করি কি আমরা?
অথচ লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনের কথা আমরা একবারও ভাবলাম না। মন্তব্য করার আগে একবারও ভাবলাম না যে, এই শিক্ষার্থীরা একাদশে তিনটি পরীক্ষা দিয়েছে, দ্বাদশে দিয়েছে টেস্ট, প্রি-টেস্টসহ আরো একটি পরীক্ষা। সমালোচনা করার আগে বিশালসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর পরীক্ষা কোন উপায়ে নেওয়া সম্ভব এমন কয়েক হাজার প্রস্তাবনাও মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েনি। স্রেফ জীবন রক্ষার্থে যখন সবাইকে আগের ফলের বিবেচনায় পাশ করিয়ে দেওয়া হলো তখনই যেন বড় ধরনের ‘অন্যায়’ করে ফেলা হলো!
অথচ ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করার জন্য কতো স্বপ্ন নিয়েই না আমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন আমাদের পিতা, পিতার পিতা। আমার চিন্তা, নীতি-নৈতিকতা যদি মানবিক গুণে গুণান্বিত না হয় তাহলে কী হবে এসব জিপিএ-৫ পাওয়া অভিভাবক হয়ে। পুরো সমাজকে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিচ্ছি আমরা বেশির ভাগ বড়রা। নিঃস্বার্থ চিত্ত, সরল ভাবনা এখন আর আমাদের আসে না। যদি স্বার্থপর হই, অন্যের অকল্যাণের চিন্তায় সময় ব্যয় করি, নিজের ভালোই ভালো, অন্যের ভালো ভালো নয়—এমন চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাই এবং সন্তানদের বড় করি তাহলে কী হবে এসব পরীক্ষা আর সন্তানের জিপিএ-৫ দিয়ে?