সাধারণ শিক্ষার্থী ও মানুষের তোপের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর হঠাৎ দেশত্যাগের খবরে বিপাকে পড়েন দলটির নেতাকর্মীরা। কেউ কেউ নেত্রীর মতো দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার জনগণের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপনে চলে যান। এরই মধ্যে মন্ত্রী-এমপি এবং দলটির উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকর্মী হত্যা মামলা, বিভিন্ন সময় অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতি মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এদিকে শেখ হাসিনা সরকার পতনের দেড় মাস হয়েছে। পরিস্থিতিও আগের তুলনায় কিছুটা শান্ত হয়েছে। এ কারণে এখন আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতাকর্মীই নিজ এলাকায় ফিরছেন। কিন্তু এই নিজ বাড়িতে ফিরতে গিয়েই আবার বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। এ জন্য গুণতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আর যারা এই টাকা দিতে পারছেন না, তাদের গ্রামে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি এলাকায় ফিরেছেন বা ফেরার জন্য অপেক্ষায় আছেন, এমন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কিছু নেতাকর্মী টাকা দিয়ে ফেরার প্রস্তাব, যারা ফিরেছেন এবং ফেরার পর বর্তমানে ঠিক কীভাবে আছেন, সেই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ফিরতে পারলেও কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো আত্মগোপনে অবস্থান করছেন।
টাকা দিয়ে ফেরার ব্যাপারে ওয়ার্ড পর্যায়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টাকা দিয়ে ফেরা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। স্ত্রী-সন্তান রেখে কতদিন পালিয়ে বেড়াব।
টাকা দিয়ে এলাকায় ফেরার জন্য এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। আর বাড়ি ফিরতে বেশ মোটা অঙ্কের টাকাই গুণতে হচ্ছে তাদের। দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার ওই নেতা বলেন, আমার কাছে তিন লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। পরে অনেক বলে-কয়ে সেটি এক লাখ টাকা করেছি।
ওয়ার্ড পর্যায়ের ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, টাকাটা বড় কোনো নেতা নেয়নি। আমাদের মতোই ওয়ার্ড পর্যায়ের এক নেতা নিয়েছেন। এ জন্য গত ৫ আগস্ট থেকেই যোগাযোগ করা হয়েছিল। তখন বিএনপির ওই নেতা রাজি হয়ে একটু ধৈর্য ধরতে হবে বলে জানিয়েছিলেন।
তবে বিএনপির তৃণমূলের যে নেতা এই অর্থ নিয়েছেন, সেই নেতার নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করতে রাজি হননি টাকা দিয়ে এলাকায় ফেরা আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেন, এটা যদি কোনোভাবে জানাজানি হয়, তাহলে আমাকে অনেক ডিস্টার্ব করবে ওরা, বোঝেনই তো। ফলে পরিবার নিয়ে আর এলাকায় থাকতে পারব না।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের ওই নেতা জানান, টাকা দিয়ে এলাকায় ফিরতে পারলেও এমন অনেকেই আছেন, যারা টাকা দেয়ার পরও এখনো এলাকায় ফিরতে পারছেন না। এমনই একজন জানান, বাড়ি ফেরার জন্য দু’জন নেতাকে দুই দফায় টাকা দিয়েছেন তিনি। এরপর তিন সপ্তাহ হয়েছে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে পারছেন না। কবে যেতে পারবেন, সেটিও জানেন না।
টাকা দেয়ার পরও এলাকায় ফিরতে না পারার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ওই নেতা বলেন, কীভাবে ফিরব। দু’জনকে টাকা দিয়েছি এটা শোনার পর আরও মানুষ ফোন করে আমার কাছে টাকা চায়। আমি কতজনরে টাকা দেব? দু’জনকে এ পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি, তবে তাতে কোনো ফল হবে না বলে এখন ভাবনা তার।
ওয়ার্ড পর্যায়ের এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, প্রথম দফায় টাকা নেয়া ব্যক্তিরা বিএনপির স্থানীয় নেতা। কিন্তু এখন যারা টাকা দাবি করছেন, তারা নিজেদের বিএনপির অঙ্গসংগঠনের বলে পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ যুবদলের নেতা, কেউ স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। তাদের টাকা না দিলে নাকি আমাকে এলাকায় পা রাখতে দেবে না।
এদিকে টাকার বিনিময়ে এলাকায় ফিরতে পারলেও তৃণমূল পর্যায়ের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই এখনো স্বাধীনভাবে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারছে না। এ ব্যাপারে ওয়ার্ড পর্যায়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, যাদের মাধ্যমে আমি এলাকায় এসেছি, তারাই আমাকে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য বলেছে। বাইরে বের হলে নাকি অসুবিধা হতে পারে।
এ অবস্থায় নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠা চালু করতে পারছেন না চল্লিশোর্ধ ওই ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ঘরবন্দী সময় টাকাতে হচ্ছে তাকে। তিনি বলেন, আমার বাজারে একটি কাপড়ের দোকান রয়েছে। যা গত দেড় মাস ধরে বন্ধ। সেটি এখন ঠিকঠাক আছে কিনা, তাও জানি না।
আবার যারা এরাকায় ফেরার পর প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন, তাদের অনেকেই হামলার শিকার হচ্ছেন। তাদেরই একজন খুলনার ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম মুন্না। তার এক আত্মীয় বলেছেন, তিন-চারজন মিলে দৌড়ানি দিয়ে রাস্তায় ফেলে তারপর কুপিয়েছে তাকে। এখন একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন মুন্না।
অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরে নূর আলম নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত রোববার রাতে সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন ঘটে এ ঘটনা। আবার গত এক সপ্তাহে বরিশাল ও চুয়াডাঙ্গায় তিনজন ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে আহতদের পরিবার থেকে এর জন্য বিএনপি ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের দোষারোপ করা হচ্ছে।
এসব ব্যাপারে বিএনপির স্থাীয় কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গত দেড় দশকে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যেভাবে আওয়ামী লীগ জুলুম-নির্যাতন করেছে, তারপরও আমাদের নেতাকর্মীরা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করি না আমি।
বিএনপি নেতা শামা ওবায়েদ মনে করছেন, একটি পক্ষ বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য দলটির নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজী করছে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে শুরু থেকেই আমাদের দলের অবস্থান কঠোর। দল থেকে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে, কেউ যেন এসবের সঙ্গে যুক্ত না হয়। এরপরও আমরা দেখছি এক শ্রেণির মানুষ বিএনপির নাম ব্যবহার করে নানা ধরনের অপকর্ম করছে।
এছাড়া কোথাও যদি বিএনপির নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে, তাহলে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নজরুল ইসলাম খান। আবার দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যদি চাঁদাবাজিসহ অন্য কোনো অন্যায়-অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ থাকে, তাহলে অভিযোগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ভুক্তভোগীকে সামনে এসে নাম ধরে অভিযোগ করতে হবে এবং তাকে অভিযোগের পক্ষে সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ দেখাতে হবে। অভিযোগের সত্যতা পেলে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লুটপাট, হামলাম চাঁদাবাজির একাধিকি অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় শতাধিক নেতাকর্মীকে শোকজ করা, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং বহিষ্কারও করেছে বিএনপি দল।