রাজধানী ঢাকার রামপুরার টেলিভিশন ভবনের পাশের একটি বাসায় একাই থাকতেন নব্বই দশকের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মনি কিশোর। গত ১৯ অক্টোবর রাতে হঠাৎই তার মৃত্যুর খবর আসে। বাসা থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এদিকে মৃত্যুর দু’দিন পার হলেও এখনো মরদেহের শেষ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। ফলে এখনো মর্গে রাখা হয়েছে গায়কের মরদেহ।
ক্যারিয়ারের শুরুতে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন মনি কিশোর। শামীমা চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। দেড় যুগ আগে সেই সম্পর্কের ইতি ঘটে। আর তার সঙ্গে বিয়ের সময় ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন তিনি। এ হিসেবে একজন মুসলিম হিসেবে তার মরদেহ দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন গায়কের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা অশোর কুমার মণ্ডল।
গায়কের এ বড় ভাই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মনি কিশোর বেঁচে থাকা অবস্থায় তার মরদেহ দাফনের ব্যাপারে একমাত্র মেয়ে নিন্তি চৌধুরীকে জানিয়ে গেছেন। অশোক কুমার বলেন, মেয়ে আমার বড় ভাইকে জানিয়েছেন, তার বাবাকে যেন দাফন করা হয়। আর এটা ওর বাবাই নাকি বলে গিয়েছে ওর কাছে। মেয়েকে যেহেতু দাফনের কথা বলে গিয়েছে, এ জন্য তার ইচ্ছা অনুযায়ীই দাফন করা হবে। এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে যাব না আমরা।
মনি কিশোরের পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, তার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে দাফন করার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে দু’দিন অতিক্রম হয়েছে। ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রমাণাদি পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারছেন না। আবার গায়কের মেয়ে নিন্তিও এখন দেশে নেই। যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন তিনি। এ জন্য মেয়ে বাংলাদেশে না আসা পর্যন্ত তার বাবা মনি কিশোরের মরদেহের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে রামপুরা থানার পুলিশ কর্মকর্তারা।
গায়কের মরদেহ উদ্ধার করেন রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক খান আবদুর রহমান। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আপাতত মনি কিশোরের মরদেহ মর্গে থাকবে। গায়কের মেয়ে দেশে ফেরার পর তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যা হওয়ার তা হবে। অথবা তিনি যদি দূতাবাসের মাধ্যমে কোনো চিঠি পাঠান বা কাউকে দায়িত্ব দেন, তাহলে তখন সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে আমাদের।
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, অন্যাথায় মনি কিশোর যে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছেন, এ ধরনের কোনো প্রমাণাদি আমাদের কাছে সরবরাহ করতে পারলেও হবে। তার মেয়ে নিন্তি চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের ওসি তদন্ত স্যারের এ বিষয়ে কথাও হয়েছে।
এদিকে ওসি তদন্ত শাহাদাত হোসেন বলেছেন, নিন্তি চৌধুরী আমাদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে একটি তথ্য পাঠিয়েছেন। তাকে পরামর্শ দিয়েছি, স্থানীয় দূতাবাস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠান যেন। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, তার বাবাকে যেন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, গায়কের পরিবার, ভাই-বোনরা চেয়েছিলেন তার মরদেহ যেন হিন্দুধর্ম অনুযায়ী দাহ করা হয়। দুই পক্ষ থেকে আলাদা বক্তব্যের জন্য এ নিয়ে বিতর্ক ও জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ জন্য মনি কিশোরের মেয়ে নিন্তি চৌধুরীকে দেশে ফিরে উপস্থিত হয়ে তাকে মরদেহ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। আর তিনি যদি কোনো কারণে দেশে ফিরতে না পারেন, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহের কথা বলেছি। তারপরই সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, নব্বই দশক থেকে সুরেলা কণ্ঠের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন জয় করে এসেছেন মনি কিশোর। বেশ আগের গাওয়া ‘কী ছিলে আমার, বলো না তুমি’ গানটি এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে শোনা যায়। আর এমন জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা দীর্ঘ সময় ছিলেন আড়ালে। অনেকটা অভিমান করেই নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন তিনি। শেষ দিকে এমনটাও হয়েছে যে, কেউ যেন যোগাযোগ করতে না পারে, এ জন্য নিজের ব্যবহৃত পুরনো ফোন নম্বরও বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দেয়া মনি কিশোর রেডিও-টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও অল্প গান গেয়েছেন। প্লে-ব্যাকেও সেভাবে গান গাইতে শোনা যায়নি তাকে।
পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সাত সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন তিনি। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। আর দেড় যুগ আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় গায়কের। এরপর থেকে একাই থাকতেন তিনি। একমাত্র মেয়ে নিন্তি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। ১৯৫৮ সালে নড়াইল জেলার লক্ষ্মীপুরে মামাবাড়িতে জন্ম মনি কিশোরের।