আজ ২৫ মার্চ। বাঙালির ইতিহাসে এ দিবাগত রাত চিহ্নিত হয়ে আছে বর্বর গণহত্যার স্মারক ‘কাল রাত’ হিসেবে। ১৯৭১ সালের এ রাতে নিরপরাধ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পৈশাচিক হত্যার উল্লাসে। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে। এ গণহত্যা আজও বিশ্ববিবেকের কাছে মানবতার লঙ্ঘন ও বর্বরতার এক ঘৃণ্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বিভীষিকাময় সেই কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এ হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরে। যার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের টানা নয় মাস ধরে। তবে এ নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে অসীম সাহসী বাঙালিও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। সেখান থেকে ভারী ট্যাংক ও সেনাবোঝাই লরিগুলো নল উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। একে একে ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলসহ সব হলেই হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। এক রাতে তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী শহীদ হন। অন্যদিকে নৃশংসভাবে শাহাদাত বরণ করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি নগরজুড়েও রাতভর চলে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তাণ্ডব। এ রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তটি প্রত্যৰ করেছিল, অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যা। ন’মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র ন’মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই।
গণহত্যার লক্ষ্যবস্তু : ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্স বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং আধা-সামরিক আনসার মুজাহিদ বাহিনীর লোক। · হিন্দু সম্প্রদায়। অ্যান্থনি কুমিল্লায় থাকাকালীন সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের মুখে বলতে শুনেছেন: আমরা কেবল হিন্দু পুরুষদের হত্যা করছি, হিন্দু নারী ও শিশুদেরকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমরা সৈনিক, নারী শিশুদেরকে হত্যা করার মত কাপুরুষ আমরা নই। · ছাত্র-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তরুণদের দল ও কিছু সংখ্যক ছাত্রী। যারা ছিলেন অধিকতর সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন। · অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মত বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। যারা সংগ্রামী বলে সেনাবাহিনী কর্তৃক সর্বদা নিন্দিত হতেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে এই গণহত্যা পৃথিবীর বর্বরতার ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। তথাপি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, এটি ছিল অতি দুর্বল ও মূলত আত্মঘাতী একটি পরিকল্পনা। এই আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে অতি স্বল্প সময়ে সেখানে তাদের আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু ঢাকার ভিতরে নির্বিচার হত্যকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকার বাইরে ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয় যার পরিণতি ছিল নিশ্চিত বিদ্রোহ। ২৫/২৬ মার্চের রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জরগণের উপর আক্রমন চালিয়ে গণহত্যা পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের জন্য আত্মঘাতী এবং দুর্বল। কারণ পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল গণহত্যার মাধ্যমে বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে আনুগত্য ফিরিয়ে এনে বিদ্রোহের অবসান ঘটানো। কিন্তু ঢাকায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং বিশেষত রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পীলখানায় ইপিআর সদর দফতরে হামলার পরিণতিস্বরুপ ঢাকার বাইরে বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। প্রাথমিক বিদ্রোহসমূহ : সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে যে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে তা হল ঢাকার রাজারবাগ, পীলখানা এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের পাইকারীভাবে হত্যা করতে শুরু করেছে। এই খবর পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা মূলত দেশপ্রেমের তাগিদে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের পিছনে কোন সংগঠিত রাজনৈতিক বা সামরিক চালিকা শক্তি ছিলনা। অবশ্য বাঙালিরা মার্চের উত্তাল দিনগুলির শেষে স্বাধীনতার জন্য অনেকটাই উন্মুখ হয়ে ছিল। টিক্কা খানের লক্ষ্য ছিল ৭২ ঘন্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনা। সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমেও তিনি তা করতে পারেননি যার কারণ ছিল বাঙালিদের এই বিদ্রোহ। মূলধারা ‘৭১ গ্রন্থের লেখক মঈদুল হাসানের মতে উদ্ভূত বিদ্রোহসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ কারণে ৮ইবি এবং ইপিআর বাহিনীর বিদ্রোহ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণটি এরকম: বিদ্রোহের পরপর স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র এই বিদ্রোহীদের দখলে আসে। এ সময় ২৬ মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮ইবির সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমান এই বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ এর পর সাধারণ মানুষ জানতে পারে যে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালিরা দেশ স্বাধীন করার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে।
অভিযানের ভিত্তি ১. আওয়ামী লীগের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াকে বিদ্রোহ হিসেবে ধরে নেয়া হবে এবং যারা সামরিক শাসনের বিরোধিতা করবে তাদের শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ২. যেহেতু সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যদের মধ্যেও আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন রয়েছে, তাই এ অভিযান অত্যন্ত চাতুর্য, চমক, ছল ও গতির সাথে সম্পন্ন করতে হবে। সাফল্যের শর্ত
· মুজিবের বাসগৃহে অভিযানের জন্যে বেসামরিক যান ব্যবহার করা যেতে পারে। ২৫-শে মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্য রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হত্যার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নৃজাতি নির্মূল করার পরিকল্পনা হাতে নেয়, যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এই আক্রমণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় যা দীর্ঘ নয় মাস দীর্ঘস্থায়িত হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫-শে মার্চের রাতেই ঢাকা শহরের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। কিন্তু তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্কল্পবদ্ধ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পাবনায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫তম পদাতিক বাহিনী স্থানীয়দের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলশ্রুতিতে, তারা রাজশাহীর ব্যাটেলিয়ন সদরদফতর থেকে জনবল ও রসদের যোগান চায়। মেজর রাজা আসলাম পাবনা এসে পৌঁছেন, কিন্তু রাজশাহীর দিকে পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। তাদের বিচলন ব্যাহত হয় স্থানীয় বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের ফলে। স্থানীয় বাঙালি বাহিনী অবরোধক স্থাপন করে এবং নাটোরের ধানাইদহে একটি সেতু ধ্বংস করে আক্রমণ প্রতিহত করতে। গোপালপুর রেলফটকে স্থানীয় স্টেশনকর্তা রেলওয়ে বগিসমূহ দিয়ে অবরোধক তৈরি করেন। মার্চের ৩০ তারিখে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওয়ালি ময়না গ্রামের কাছে যাত্রাবিরতি নেয়ার কালে বাঙালি যোদ্ধাদের একটি দল তাদের আক্রমণ করে স্থানীয় সাঁওতালদের সাহায্য নিয়ে। স্থানীয়দের কাছে ময়নার যুদ্ধ নামে পরিচিত এই সংঘর্ষে চল্লিশজন বাঙালি যোদ্ধা নিহত হন। যদি-ও পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম ছিল, তদাপি তাদের মনোবলে ছেদ পড়ে। রাতে পাকিস্তানিরা ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরবর্তী দিন, তাদের অনেকেই স্থানীয় বাঙালিদের হাতে ধরা পড়ে; অন্যতম ছিল নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা মেজর আসলাম। সেনাদের স্থানীয় বাঙালি বাহিনীর নেতা ও উত্তরবঙ্গ চিনিকলের সাধারণ ব্যবস্থাপক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম এর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সংক্ষিপ্ত বিচারকার্যের পরে লালপুর এসএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী শ্যামলাল আগরওয়ালা জানান, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাত থেকে সৈয়দপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর সৈয়দপুরের বিহারিরা বাঙালি নিধন শুরু করে। মহল্লায়-মহল্লায় ঢুকে নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল শহরের মাড়োয়ারিপট্টির বাসিন্দারা। ২৪ মার্চ থেকে সৈয়দপুর শহরের বাঙালি পরিবারগুলো পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সৈয়দপুরের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে স্থানীয় মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের শীর্ষব্যক্তিত্ব তুলসীরাম আগরওয়ালা, যমুনাপ্রসাদ কেডিয়া, রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাকে ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের অদূরে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মাড়োয়ারিপট্টিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিহারিরা মাড়োয়ারিদের বাসায় বাসায় চালায় লুটতরাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালীন সকল আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান এবং রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙ্গালীর স্বাধীনতার দাবী দমন করার প্রয়াসে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে গণহত্যার পরিকল্পনা করে, যা ২৫ মার্চ রাতে বাস্তবায়ন করা হয়।
২৫ মার্চের কাল রাত : ২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়াকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ন। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিলো ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এই সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্থানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে। শিক্ষক হত্যাকাণ্ড : ২৫ মার্চের গণহত্যার (অপারেশন সার্চলাইট) প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। অধ্যাপক ফজলুর রহমান এবং তার দুই আত্মীয় নীলক্ষেতের ২৩ নং ভবনে নিহত হন। তাঁর স্ত্রী দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। পাকবাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা এবং অধ্যাপক রশিদুল হাসানের (ইংরেজি বিভাগ) বাসভবন আক্রমণ করে। তাঁরা দুজনেই খাটের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান, কিন্তু পরবর্তীতে আল-বদর বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। ২৪ নং ভবনে বাংলা সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন। তাঁর বাসভবনে প্রবেশমুখে দুইজন আহত নারী তাদের সন্তানসহ কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রক্তের দাগ লেগে ছিলো মাটিতে। পাকবাহিনী যখন তাঁর বাসভবন আক্রমণের জন্য আসে, তখন তারা রক্তের দাগ দেখে ধারণা করে নেয় অন্য কোন ইউনিট হয়তো এখানে কাজ সমাধা করে গেছে, তাই তারা আর প্রবেশ করেনি। এভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি জানান যে, ওই ভবনে আরও একজন পূর্ব-পাকিস্থানী অধ্যাপক বাস করতেন, যিনি ২৫ মার্চের আগেই ঘর ছেড়ে যান। অন্যসব বাসায় অবাঙ্গালী কিছু পরিবার থাকতো, যারা অন্যদের কিছু না জানিয়েই ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যায়। ১২ নং ফুলার রোডের বাসভবনে পাকিস্থানী আর্মি সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নোকির বাসায় যায়। আর্মি তাকে ছেড়ে দিলেও ওই একই ভবনের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুক্তাদিরকে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ জহরুল হক হলে (তদানীন্তন ইকবাল হল) পাওয়া যায়। পরে তাঁর আত্মীয়েরা তাঁকে পল্টনে সমাহিত করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ক ম মুনিম, যিনি সেই সময় সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে ছিলেন, পাকিস্থানী বাহিনীর আক্রমনে আহত হন। ঢাকা হলের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম ও শরাফত আলীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্থানী বাহিনী জগন্নাথ হলে শিক্ষকনিবাসে আক্রমণ করে এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হুদা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরকে লাঞ্ছিত করে। তৎকালীন সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমণের সময় হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করা হয়। পাকিস্থানী বাহিনী ভূতপূর্ব-প্রভোস্ট এবং জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেবকে হত্যা করে, সংগে তাঁর মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকেও। এর পর পাকিস্থানী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী বাসভবনে আক্রমণ করে এবং সেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামানকে তাঁর পুত্র ও আত্মীয়সহ হত্যা করে। জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হলের ইলেক্ট্রিসিয়ান চিত্রাবলী ও চাক্ষুস সাক্ষী রাজকুমারী দেবী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা অধ্যাপক ঠাকুরতাকে চিনতে পারেন এবং তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কাছে একটি গাছের নিচে সমাহিত করেন। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সাথে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকেও রাখা হয় এবং পরে হত্যা করা হয়। সহযোগী হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও ছাত্রাবাসেই হত্যা করা হয়। অধ্যাপক আনোয়ার পাশার উপন্যাস “রাইফেল, রোটি, অওরাত” থেকে এ তথ্য জানা যায়। অধ্যাপক পাশা পরবর্তীতে ডিসেম্বর মাসে আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হন। তিনি তাঁর এই জনপ্রিয় উপন্যাসটি ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন ৯ মাসে রচনা করেন।
ছাত্রহত্যা : অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ”কে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। অধ্যাপক ড. ক ম মুনিমের মতে, এই হলের কম-বেশি ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করে। রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে এবং প্রথমে মর্টার আক্রমণ চালায়, সেই সাথে চলতে থাকে অবিরাম গুলি। তারা উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। সেই আঘাতে ৩৪ জন ছাত্র প্রাণ হারান। জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র রমনা কালী বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। সেখানে ৫/৬ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের নাম পরবর্তীতে জানতে পারা যায়, তার নাম রমণীমোহন ভট্টাচার্য্য। ছাত্রদের কাছে আসা অনেক অতিথিও এই সময় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পল, জগন্নাথ হলের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর। ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সেসময় হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হলে পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমনে নিহত ছাত্রদের তালিকা : • উপেন্দ্র নাথ রায়: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (গ্রাম: গুলিয়ারা, দিনাজপুর) • কার্তিক শিল : শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (কলাখালি, বরিশাল) • কিশোরী মোহন সরকার : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ইংরেজি (পারাগ্রাম, ঢাকা) • কেশব চন্দ্র হাওলাদার : প্রথম বর্ষ গণিত (কাঁচাবালিয়া, বরিশাল) • গণপতি হাওলাদার: রসায়ন (ঘটিচরা, বরিশাল) • জীবন কৃষ্ণ সরকার : শেষ বর্ষ রসায়ন (কুলপাতক, ময়মনসিংহ) • নণী গোপাল ভৌমিক : দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র (শ্যাম গ্রাম, কুমিল্লা) • নির্মল কুমার রায় : প্রথম বর্ষ এমকম • নিরঞ্জন প্রসাদ সাহা : প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান • নিরঞ্জন হালদার: শেষ বর্ষ স্নাতকোত্তর পদার্থবিজ্ঞান (শিকড়পুর, বরিশাল) • প্রদীপ নারায়ন রায় চৌধুরী: প্রথম বর্ষ স্নাতকোত্তর ছাত্র। কর্মকর্তা-কর্মচারী হত্যা : জহরুল হক হল আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর গার্ডদের হত্যা করা হয়। তারপর হলের কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী ও আব্দুল মজিদকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লাউঞ্জে হত্যা করা হয়। রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় আহমেদ আলী, আব্দুল খালেক, নমি, মোঃ সোলায়মান খান, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ হাফিজুদ্দিন ও মোঃ চুন্নু মিয়াকে। শহীদ মিনার ও বাংলা অ্যাকাডেমী আক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাদলটি শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন শিক্ষকনিবাসগুলোয় এবং মধুসূদন দে’র বাসভবনেও আক্রমণ করে।