লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্য বলাই
চট্টগ্রাম শহরের অতি প্রাচীনতম স্থাপনার নাম সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সি.আর.বি)। চট্টগ্রাম শহরের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে সি.আর.বি ভবন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। কালজয়ী ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী এ ভবন। দেশের কম মানুষ এ ভবন সম্পর্কে জানে। পাঠক সচেতনতা ও ইতিহাসের স্বার্থে এই প্রবন্ধে সি.আর.বি ভবনের ইতিহাস তুলে ধরা হলো।
প্রত্যেক জাতির এমন কিছু সম্পদ থাকে যা নিয়ে সে জাতি গর্ব করে বলতে পারে তার গৌরবময় অতীতের কথা। বলতে পারে আমাদের বর্তমানই শুধু সমৃদ্ধ নয় অতীত ও গৌরবের। সি.আর.বি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) এমনি একটি প্রতিষ্ঠান শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে স্বীয় অস্তিত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে ১৮৯৯ সাল থেকে। পাহাড় আর অরণ্যরাজি ঘেরা শতায়ু পেরুনো বিরাট বিরাট মহিরূহ সদৃশ শাল, সেগুন, গর্জন, রেইনট্রির ছায়া ঢাকা সাত রাস্তার সংযোগস্থল অনেকগুলো পাহাড়ের একটাতে প্রায় ১০ একর জমির উপর সি.আর.সির বিস্তৃত অবস্থান। ১৮৬২ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকার তদানিন্তন পূর্ববঙ্গের দর্শনা থেকে জাগতি পর্যন্ত ৫৩.১০ কি.মি. ব্রডগেজ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে এতদ্বাঞ্চল রেলপথের গোড়াপত্তন করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষের আসাম অবিভক্ত বাংলা সহ পূর্বাঞ্চলে রেলওয়ের কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য ১৮৮৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা করে। লন্ডনে নিবন্ধনকৃত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শুরুতে প্রাই. লি. কো. হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরে সময়ের প্রয়োজনে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে ৮৯১ সালে। ১৬/১১/১৮৯২ইং, গেজেটমূলে ফেনী থেকে রেলওয়ে চট্টগ্রামের বটতলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্যই কেন্দ্রীয় রেল ভবন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান ও চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন সুবিধাকে রেলওয়ের সাথে সমন্বিত করার প্রয়াসেই ১৮৯৯ইং সালে সি.আর.বি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বৃটিশরা এদেশ দখলে নেওয়ার পর চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা করে বৃটিশ সরকারের প্রতিরক্ষা ও পরিবহন মন্ত্রণালয় যা ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত একীভূত ছিল, কদমতলী থেকে টাইগারপাস হয়ে পাহাড়তলীর বিস্তীর্ণ এলাকাসহ কমিশনারের বাংলোটিলা, সার্কিট হাউস, জমিয়াতুল ফালাহ, স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম ক্লাব, নেভাল এভিন্যু, লালখান বাজার ও অন্যান্য স্থান সহ ২০৯ একর ভূমি নিয়ে পুরাতন ক্যান্টনমেন্ট এর আওতাভুক্ত করে সামরিক এলাকায় পরিণত করে ১৮৭০ সালের দিকে। রেলওয়ের প্রতিষ্ঠার পর ১৪/১১/১৮৯৩ তার গেজেট মূলে ঐ ভূমি থেকে ১৬০ একর জমি রেলওয়ের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এই হস্তান্তরকৃত ভূমিতে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিয়ে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় সি.আর.বি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাংলো, ক্লাব ইত্যাদি।
ইংরেজ ও ভারতের মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন অপূর্ব শোভামণ্ডিত সি.আর.বি শুরুতে ইউ (ট) আকারের এক বিশাল ইমারত যা বর্তমানে চতুর্ভুজ আকারের মনে হয়। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত একই উচ্চতা বিশিষ্ট তিন তলা আর দক্ষিণ প্রান্ত অনন্য সাধারণ কারুকার্য খচিত চিলেকোঠাসহ তিন তলা। উত্তর প্রান্ত অনেকটা দায়সারা গোছের যা পরে সময়ের তাগিদে গড়ে তোলা হয়। দক্ষিণ পূর্ব দিকে থেকে মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে বাঁয়ে গেলে ভবনের মূল প্রবেশ দ্বার। কেনটিলিভারের নিচে সুরমা প্রবেশ পথ দিয়ে সামনে এগোলে লাল কার্পেটে মোড়ানো জমকালো সিঁড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠতে গেলে নিজের সমৃদ্ধ অতীত আপনাকে অবশ্যই আত্মতৃপ্তি দেবে। দক্ষিণ প্লাজা ভবনের সম্মুখভাগ, সমান দূরত্বের তিনটি সিঁড়ি পথকে গম্বুজের নিচে গম্বুজের নিচে তিনটি আলাদা প্রাসাদ বলে মনে হয়। অন্যান্য সিঁড়িগুলি ভবনের বিভিন্ন জায়গায় সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত। দোতলা থেকে অনেকগুলো লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি ছাদ পর্যন্ত চলে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের ভবনের পূর্বাপ্রাপ্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। স্বাধীনতা উত্তর অবিকল ভাবে পুনঃনির্মাণ করা হয়, অবশ্য কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গেছে, হয়তো বা সময়ের ব্যবধানের কারণে। চুন সুরকির সাহায্যে লাল ইটের গাঁথুনির দেয়াল কোথায় চল্লিশ ইঞ্চি পুরু। পাথরের মত জমাট বাঁধা দেওয়ালগুলো যেন মাত্র সেদিনই তৈরি হয়েছে, সামান্য চুনকাম করা কক্ষগুলোতে শতাব্দী প্রাচীন আসবাব নথিপত্র দেখতে গর্বে বুক ভরে উঠে। নকশাকাটা কারুকার্য ভরা কাঠের ফ্রেমে কাঠের দরজা জানালাগুলো লোহার মতো মজবুত ও টেকসই। সম্মুখ ভাগ অর্থাৎ দক্ষিণ উইংস অপূর্ব শোভামণ্ডিত কাঠের কারুকার্য খচিত চিলেকোঠা সহ তিনতলা অত্যন্ত পরিপাটি সুসজ্জিত ও রং চকচকে দেখলে মনে হয় নতুন ইমারত। অবশ্য এতকিছুর পরও সি.আর.বির গায়ে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। নিচতলার সিলিং এর পলেস্তারা খসে পড়েছে, বিভিন্ন স্থানে শেওলা পড়ছে, দেয়ালে জন্মাচ্ছে পরগাছা, এতে এ ঐতিহাসিক ইমারত হয়ে উঠেছে বিবর্ণ, শ্রীহীন ও ক্ষয়িঞ্চু। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এর স্থায়িত্ব দেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী; বিশেষজ্ঞ না হয়েও এ প্রত্যাশা করতে পারি।
সাত রাস্তার মোড় হয়ে এগোলে প্রথম নজরে আসবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়া শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিফলক, তারপর নজরে আসবে ১৮৯৯ সালের তৈরি বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিনের মডেল। ভবনের দক্ষিণ দিকে বিরাট আঙিনায় দায়সারা গোছের ফুলের বাগান দেখলে অব্যবস্থাপনার ছাপ ফুটে উঠবে। সি.আর.বির পূর্ব দিকে রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে রেলওয়ে হাসপাতাল অবস্থিত। এটা একসময় ছিল ফিরিঙ্গি অফিসারদের ক্লাব, কর্মক্লান্ত কর্মকর্তারা কাজের বাইরের সময়টুকু এখানে আমোদ-প্রমাদ করে কাটাতেন, আড্ডা দিতেন, নিজ দেশে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজনের গল্প করতেন। সি.আর.বির সুবিধার সাথে ছিল চিত্ত বিনোদনের বন্দোবস্ত, ছিল কাঠের পাটাতনের নাচ ঘর। নর্তকীর নূপুরের ঝংকার আর সুরের মূর্ছনায় আন্দোলিত হত কাঠের পাটাতনের সাথে সাহেবদের হৃদয়। যা আজ রূপকথার মতো শোনাবে।
একদা সি.আর.বি ছিল এতদ্বাঞ্চলের সর্ববৃহৎ কর্মচঞ্চল ভবন, সরকরের লাট বাহাদুর, আমলা, পাইক পেয়াদা, কেরানী, চাপরাশি, মালী, কুলির পদচারণায় কর্মমুখর। আশা ভরসার স্থল ও সুখ দুঃখের কেন্দ্রবিন্দু। কালের বিবর্তনের লাখো মানুষের হাসি কান্নাকে বুকে ধারণ করে সি.আর.বি আজও দাঁড়িয়ে আছে অতীতের সাক্ষী হয়ে। কালের চাকার ঘূর্ণাবর্তে সি.আর.বি আজ শ্রীহীন পুরাতন ভবন মাত্র যা বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক দপ্তর। সি.আর.বির কর্মযজ্ঞের উপর প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর, অতপর ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রশাসন পৃথক হওয়ার পর, সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েকে দুটি জোনে বিভক্ত করে ঢাকার সদর দপ্তর স্থাপন করার পর। এত কিছুর পরও সি.আর.বি আছে থাকবে আগামী প্রজন্মের জন্য গৌরব গাথা হয়ে। এক সময় রেলওয়েতে এক লক্ষ মানুষ কর্মরত ছিল বলে জনশ্র“তি থাকলেও বর্তমান রেলওয়েতে এক লক্ষ মানুষ জন এডিশনাল ডিজি, ১ জন জেটি-ডিজি, রেক্টর এবং মাঠ পর্যায়ে ৫ জন জিএম ও ৬ জন ডিভিশনাল ম্যানেজারের অধীনে কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিক মিলে ৩৫,৫০০ জন কর্মী কর্মরত আছে। বৃহত্তর বরিশাল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদ দিলে সারাদেশ, হলদিয়া-বাড়ি থেকে দোহাজারী, বেনাপোল থেকে করিমগঞ্জ পর্যন্ত রেলওয়ের বিস্তৃত জাল বিছানো, সারা দেশে অসংখ্য পুরোনো স্থাপনার সাথে সাথে গড়ে উঠেছে ঢাকার সুরম্য সদর দপ্তর, আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নির্দশন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের স্টেশন সমূহ। অনেক পরিবর্তন আনার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার ফলেও রেলের সেবার মানকে অদ্যাবধি বিশ্বাসযোগ্য অবস্থায় আনা সম্ভব হয়নি। মালামাল পরিবহনও নিুমুখী। তারপরও আশার বাণী শুনতে ভাল লাগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ম্যাগনেটিক ট্রেন চালু হবে অথবা লাকসাম-ঢাকা কর্ডলাইন।
শুনলে খুশী লাগে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক ঘণ্টায় পারাপার। ১৮৬২ সালে ৫৩.১০ কি.মি. রেলপথ দিয়ে যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ ১৪৫ বৎসরের পথ পরিক্রমায় আজও রেল লাইনের পরিধি ২৭৯২ কি.মি. সীমাবদ্ধ (যার ট্রেক কি.মি. ৪৩৮১) এর মধ্যে কোথাও কোথাও আবার সংকুচিত হয়ে আসছে অলাভজনক বোঝা বলে। রেলওয়ে সরকারি সম্পদ নিজের নয়! এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে রেলওয়ের প্রতিটি সম্পদ নিজের এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও হেফাজত করা গোটা জাতির পবিত্র দায়িত্ব, ভাড়ার বিনিময়ে রেলের সেবা নেব এবং দেব এই চিন্তা যদি যাত্রী এবং রেলকর্মীদের থাকে তবেই আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে রেলের ৪৫৪টি স্টেশন। সারাদেশে রেলের অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে রেল তার হৃদ গৌরব ফিরে পাবে এবং সর্বাধুনিক রেল যোগাযোগ জাতিকে করবে গর্বিত, এই প্রত্যাশার সাথে আরও একটি প্রত্যাশা সি.আর.বির মত এই আলীশান ভবন আর রেলের পূর্বাঞ্চলীয় কার্যালয় হিসেবে অপ্রয়োজনীয় ও বেমানান মনে হয়।
সি.আর.বির সন্নিহিত এলাকায় আঁকা-বাঁকা, সর্পিল রাস্তা উঁচু নিচু পাহাড় টিলা, বন-বনানী ছায়া সুনিবিড় এই বিরাট এলাকা অঘোষিত পর্যটন স্পট হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষকে দিয়ে আসছে বিনোদনের আস্বাদন। সরকার যদি আন্তরিক হন তবে সি.আর.বিকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে অনন্য সুন্দর পর্যটন জোন। সি.আর.বি লাগোয়া উত্তর টিলায় লোজ্জ ক্লান, দুপাহাড়ের মাঝখানে গভীর খাদ, যার শেষ প্রান্তে বেরিয়েছে পশ্চিম প্রান্তের মূল রাস্তায় পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে যেখানে উঁচু বাঁধ দিয়ে তৈরি করা যাবে শত ফুট গভীরতার স্বচ্ছ সরোবর। অনেকগুলো শাখা প্রশাখা নিয়ে তা হবে ফয়স লেক। সি.আর.বির মূল নকশাকে অবিকল রেখে আধুনিক সুবিধা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এটাকে পর্যটন হোটেল হিসেবে এবং বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অটুট রেখে বিভিন্ন পর্যটন উপকরণে সমৃদ্ধ করে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসবেন ক্লান্তি অপনোদন ও আনন্দ আহরণে, দেশ ও জাতি লাভবান হয়ে দুদিক থেকে বিত্ত ও ঐশ্বর্যে। গেল চার/পাঁচ বছর ধরে সি.আর.বি পাহাড়ি জনপদের এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার আশপাশ ও পাহাড়ের তলদেশে বাঙালির সর্ববৃহৎ বৈশাখী উৎসব ও ঐতিহ্যবাহী সাহাবুদ্দিনের বলীখেলায় লক্ষাধিক লোকের জমায়েত ঘটে। বলা যেতে পারে বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামে সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র এই সি.আর.বি।
লেখক:
অধ্যক্ষ ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই
লেখক ও মরমী গবেষক
সভাপতি, চট্টগ্রাম সাহিত্য সমাজ অনুশিলন কেন্দ্র
চট্টগ্রাম।