
অবশেষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কাঙ্খিত সে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচন। দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস স্থগিত থাকার পর আজ বুধবার (২৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন।
করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে স্থগিত হওয়া চসিক নির্বাচন আবার করোনাভাইরাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী (নৌকা প্রতীক) ও বিএনপির শাহাদাত হোসেন (ধানের শীষ) সহ মোট সাত মেয়র প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্ধিতা রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে।
সাধারণ ভোটারদের মনে প্রশ্ন এবারের নির্বাচনে কার হাতে যাচ্ছে নগর উন্নয়নের দায়িত্ব। অথ্যাৎ কে হচ্ছেন নগর পিতা..? অতীতের মত ভোট কারচুপি হলে এক রকম হিসেব এবং সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে পারলেই ভোটের হিসেব নিকেশ পাল্টে যেতে পারে বলে ধারণা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের।
অন্য পাঁচ মেয়র প্রার্থীরা হলেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা), এনপিপির আবদুল মন্জুর (আম), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মতিন (মোমবাতি), ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার) এবং স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী খোকন চৌধুরী ( হাতি)।
এছাড়া ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং ১৪টি সংরক্ষিত আসনে ৫৭ জন মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নগরীর প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ মানুষ ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দিয়ে তাদের নগর পিতা নির্বাচন করবেন। নির্বাচন সম্পন্ন করতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের প্রচারণা মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) শেষ হয়েছে।
ভোটের নিরাপত্তায় গত সোমবার থেকেই মাঠে নেমেছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। নগর পুলিশের ৭ হাজার ২৫৯ সদস্যসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর প্রায় ৯ হাজার সদস্য আজ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছে। অতীত সহিংসতার ইতিহাস, প্রার্থীদের অবস্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার চসিক নির্বাচনে ৭২৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪১৭টিকে (প্রায় ৫৮ শতাংশ) ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ভোটের দিন এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হবে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
নির্বাচন কমিশন সুত্রে জানাগেছে, চসিক নির্বাচনের ৪১ ওয়ার্ডে ৭৩৫টি ভোট কেন্দ্রে থাকবে ৪ হাজার ৮৮৬টি বুথ। এসব কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন ৭৭৫ প্রিসাইডিং অফিসার, ৪ হাজার ৮৮৬ সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ৯ হাজার ৭৭২ পোলিং অফিসার।
এবার চসিক নির্বাচনে ভোটার ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৯৭৮। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭২৩ ও নারী ভোটার ৯ লাখ ৫২ হাজার ৩২৯ জন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. আলমগীর চসিক নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, চট্টগ্রামের নির্বাচন সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতা ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য যা যা দরকার আমাদের পক্ষ্য থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারিশ বলেন, চসিক নির্বাচনে নগর ও হাটহাজারী উপজেলা মিলিয়ে ৭৩৫টি কেন্দ্র আছে। কেন্দ্রগুলোর অতীতের সহিংসতার ইতিহাস, প্রার্থীদের অবস্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে প্রায় ৮ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েনসহ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। ২৫ প্লাটুন বিজিবি মোবাইল টিমে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে সব কেন্দ্রে কাজ করবে।
তিনি জানান, এসব কেন্দ্রে অস্ত্রধারীসহ ছয়জন করে পুলিশ সদস্য ও ১২ জন করে আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে। আর এই বাইরে সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রধারীসহ চার জন পুলিশ ও ১২ জন করে আনসার সদস্য থাকবে।
এছাড়া, কেন্দ্রের বাইরে টহল পুলিশ, সাদা পোশাকের পুলিশ ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা তৎপর থাকবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকবে নগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ও সোয়াট।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, নির্বাচনের সার্বিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ৬৯ জন ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের দিন মাঠে সক্রিয় থাকবেন। তাদের নির্দেশনায় মাঠে কাজ করবেন বিজিবি সদস্যরা। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ২৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
এবারের চসিক নির্বাচনে ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকছে না। তাই এদিন বন্দরনগরীতে যানবাহন চলাচল ও অফিস-আদালত যথারীতি চলবে বলে আগেই জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে কার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ বেশ কয়েক ধরনের যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সিএমপির জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ মো. আবদুর রউফ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, সিএমপির আওতাধীন এলাকায় ভোটগ্রহণের জন্য মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত কার, মাইক্রোবাস, জিপ, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা, ইজিবাইক, ট্রাক, পিকআপ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে গত সোমবার মধ্যরাত থেকে জারি হওয়া মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত। তবে এই নিষেধাজ্ঞা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের (পরিচয়পত্র থাকতে হবে) ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য।
তাছাড়া, নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বৈধ পরিদর্শক এবং জরুরি সেবা যেমন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
তিনি জানান, এর বাইরে জাতীয় মহাসড়ক, বন্দর ও জরুরি পণ্য সরবরাহ সহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান। তিনি কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
চসিক মেয়র পদে সাতজন এবং ৩৯টি সাধারণ ও ১৪টি সংরক্ষিত আসনের বিপরীতে ২২৫ জন প্রার্থীর মধ্যে বুধবার ভোটের লড়াই হবে বন্দর নগরীতে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে সংঘাতে প্রাণ গেছে দুজনের।
কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর, প্রচারণায় হামলাসহ বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। ৭৩৫ টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১৯টিকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, যা মোট কেন্দ্রের ৫৬ শতাংশ।