নুরুল আলম নুরু। টগবগে এক যুবক। সাচ্চা জাতীয়তাবাদী। ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ সাধারণ সম্পাদক। দলের জন্য এমন নিবেদিত প্রাণ কর্মী খুব কমই আছে।
নুরু ছিল অসম্ভব বিনয়ী ও ভদ্র। ঢাকায় থাকলে প্রায় দিনই সময় করে প্রেস ক্লাবে আমার সাথেই দেখা করে যেতেন। তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী হেল্প সেলের হয়ে কাজ করতেন গুম,খুন ও নির্যাতিত ফ্যামিলির জন্য। যেখানে গুম, যেখানে খুন বা নির্যাতন সেখানেই ছুটে যেতেন মানব দরদি নুরু।
সর্বশেষ গত শনিবার আমাকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির লেলাং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আলম সিরাজ চেয়ারম্যানের শহরের বাসায়। ২০১২ সালে বিএনপির এ নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার পথে গুম হন। সিরাজ চেয়ারম্যানের ছেলেকে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিলেন ‘আংকেল’ প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবে। আমি সবসময় তোমাদের পাশে থাকবো। কি আদর মাখানো আহবান তাঁর। কে জানতো মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় নিজেই গুমের পর হত্যার শিকার হবেন!
গতকাল বুধবার রাত ১২টার দিকে আমাকে জানানো হলো নুরুকে তাঁর চট্টগ্রাম শহরের বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে। আমি জানতে চাইলাম পুলিশ না ডিবি। নুরুর ভাগিনা রাশেদ জানালো পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি যুবক শ্রেণীর ৪জন ছিল জিন্সের প্যান্ট পড়া। তার দেয়া বর্ণনা মতে, রাত পৌনে ১২টার দিকে কেউ এসে দরজা নক করলো। রাশেদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতে না দিতেই পুলিশ ও একদল যুবক হুড়মুড় কর ভেতরে ঢুকে সবার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিলো। এরপর বেড রুমে গিয়ে নুরুকে ধরে ফেলে। নুরু ছিল খালি গায়ে। তার পাশে সোয়া ছিল স্ত্রী ও সদ্যজাত প্রিয় সন্তান। নুরুকে টিশার্ট পরিয়ে হাতে পুলিশের হ্যান্ডকাপ পড়ানো হল। এরপর গাড়িতে তুলে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেললো। রাউজান থানার এসআই জাবেদ এ গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেন বলে নুরুর পরিবার জানান।
আমরা যখন শুনেছি রাউজান থানার পুলিশ ছিল তাই তেমন উদ্বিগ্ন ছিলাম না। আমাদের আশা ছিল আজ হয়তো কোর্টে তুলবে। রাতে পুলিশ যখন নুরুর গ্রেফতারের কথা স্বীকার করছিলো না তখন উদ্বেগ ও শংকা বাড়তে থাকে। সকাল ৯টায় ভয়ংকর সংবাদটি আসে। ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত ভাই জানালেন মনে হয় নুরু ভাই নেই। এরপর কান্নার জন্য উনি কথা বলতে পারছিলেন না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে জানালেন কর্ণফুলি নদীর তীরে একটি লাশ পড়ে আছে হাত বাঁধা,চোখ বাঁধা। স্থানীয় জনগন শরীরের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আমরা অনেকটা নিশ্চিত এটা নুরু ভাইয়ের লাশ।
বেলা ১১টায় গিয়াস ভাই (সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস কাদের চৌধুরী) আমাকে নিশ্চিত করলেন ওই মরদেহটি নুরুর। মনে হলো পুরো আকাশটি ভেঙ্গে পড়লো মাথায়। শুধু চিন্তা করছিলাম ক্ষমতার রাজনীতি কত নিষ্ঠুর, কত ভয়ংকর! নুরুর মতো এমন নম্র, ভদ্র ছেলেকে এভাবে হত্যা করতে পারলো? কি দোষ ছিল তাঁর? বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা? গুম,খুন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চারতা? নাকি বাংলাদেশে শুধু একটি দল থাকবে, কোন বিরোধী পক্ষ থাকবেনা? বেলা সাড়ে ১১টার লাশের ছবি এলো। কি ভয়ানক ছবি! আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝাড়ছিল।
ছবিতে দেখলাম, নুরুর চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। গায়ের টিশার্ট দিয়ে গলা প্যাঁচানো। দু’হাত শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। কুরবানির গরুকে জবাইয়ের আগে যেভাবে শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা হয়,সেভাবে বেঁধেছিল নুরুকে। সারা শরীরে অনেক নির্যাতনের চিহ্ন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ঠিক কপালে তিনটি গুলি করেছে খুনিরা। যেখানে গতকাল তার নিষ্পাপ শিশুরা চুমো খেয়েছিল।
যারা নুরুকে হত্যা করেছেন/হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে বলি নুরুকে যখন গুলি করেছেন তখন তার বেঁচে থাকার জন্য ছটফট করার দৃশ্যটি একটু ভাবুন। এমনটি যদি আপনার হতো, কিংবা আপনার ভাই বা বাবার।কেমন লাগতো? নুরুর নিষ্পাপ সন্তানের দিকে তাকিয়ে নিজের সন্তানের কথা একবার ভাবুন। এ শিশুগুলো আর কখনো বাবা বলে ডাকতে পারবেনা। বাবার কপালে চুমো খেতে পারবেনা। বাবার বুকে আশ্রয় নিতে পারবে না। বাবার হাত ধরে ঈদগায়ে নামাজ পড়তে যেতে পারবে না। বাবার কাছে বায়না ধরতে পারবেনা। ওদের এখন একটাই পরিচয়-ওরা এতিম। ওরা এখন সমাজে করুণার পাত্র। ওর স্ত্রীর কথা একবার ভাবুন। পঁচিশ বছরের এ মেয়েটি এখন বিধবা। তার আর কোন সাধ- আহ্লাদ থাকলো না। এ বয়সের মেয়েদের কত সাধ থাকে -আহ্লাদ থাকে, অথচ এ মেয়েটিকে গতকালই পড়ানো হয়ে গেছে বিধবার সাদা শাড়ি। খুলে নেয়া হয়েছে নাকের নথ।
কার কাছে বিচার চাইবো?
কে করবে বিচার?
হে আল্লাহ্ তুমি ছাড়া আমাদের আর কোন সহায় নেই।
অসহায় এ জাতিকে তুমি রক্ষা কর।
লেখকঃ কাদের গণি চৌধুরী কেন্দ্রিয় বিএনপি নেতা ও সিনিয়র সাংবাদিক