বিগত ঈদুল আযাহায় সারাদেশে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ২১০টি দুর্ঘটনায় ২৬৫ জন নিহত ও ১১৫৩ জন আহত হয়েছে।
বুধবার সকালে নগরীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি নেতৃবৃন্দ এ তথ্য জানান।
সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল এই প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদন পেশ কালে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর ঈদ কেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় গত তিন বছর যাবত বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। বিগত ঈদুল ফিতরে লম্বা ছুটি থাকায় ঈদযাত্রা অনেকটা স্বস্তিদায়ক হলেও এবারের ঈদে মানুষের যাতায়াতে ভোগান্তির পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে বলে দাবি করে যাত্রী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মরত সংগঠনটি।
ঈদ যাত্রা শুরুর দিন ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিগত ১২ দিনে ১৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৮ জন নিহত ও ১০৫৬ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে ৮টি নৌ দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। এ সময় রেলে কাটা পড়ে ৭ জন নিহত, চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ৫০ জন আহত হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঈদযাত্রায় ১৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনা, ৮টি নৌ দুর্ঘটনা, ৭টি রেলে কাটা ও ৩টি রেল দূর্ঘটনায় সংঘটিত হয়। এসকল দুর্ঘটনায় সর্বমোট ২৬৫ জন নিহত ও ১১৫৩ জন আহত হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, উল্লেখিত সময়ে ঈদ যাত্রা শুরুর প্রথম দিন ৭ সেপ্টেম্বর ১৬ টি দূর্ঘটনায় ২১ জন নিহত ২৪ জন আহত হয়, ২য় দিন ৮ সেপ্টেম্বর ১২ টি দূর্ঘটনায় ১২ জন নিহত ৩২ জন আহত হয়, ৩য় দিন ৯ সেপ্টেম্বর ১৪ টি দূর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ১৮৫ জন আহত হয়, ৪র্থ দিন ১০ সেপ্টেম্বর ১৫ টি দূর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত ৫৪ জন আহত হয়, ৫ম দিন ১১ সেপ্টেম্বর ২০ টি দূর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ১৭৬ জন আহত হয়, ৬ষ্ঠ দিন ১২ সেপ্টেম্বর ১৩ টি দূর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত ৫৪ জন আহত হয়, ৭ম দিন ১৩ সেপ্টেম্বর ১০ টি দূর্ঘটনায় ১২ জন নিহত ২১ জন আহত হয়, ৮ম দিন ১৪ সেপ্টেম্বর ২৭ টি দূর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত ১৬৪ জন আহত হয়, ৯ম দিন ১৫ সেপ্টেম্বর ১৩ টি দূর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ৮৭ জন আহত হয়, ১০ম দিন ১৬ সেপ্টেম্বর ২৩ টি দূর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত ১৮৩ জন আহত হয়, ১১তম দিন ১৭ সেপ্টেম্বর ২৯ টি দূর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত ১০৪ জন আহত হয়, ১২তম দিন ১৮ সেপ্টেম্বর ১৮ টি দূর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ৯২ জন আহত হয় ।
এদিকে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলায় ট্রাকের ধাক্কায় হরিনারায়নপুর ইউপি সদস্য সিদ্দিকুর রহমান, ঝিনাইদহে ট্রেনে কাটা পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিদ্যা নিকেতনের সহকারী শিক্ষক রবিউল ইসলাম, ঝিনাইদহের শৈলকুপা এলাকায় বাইক খাদে পড়ে নিহত হয়েছে নড়াইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই জাহিদুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ট্রাকের ধাক্কায় পুলিশ কনষ্টেবল আবু মুসা, গোপালগঞ্জ বাস-কারারক্ষী জিপ সংঘর্ষে হাসান নামের এক কারারক্ষী নিহত হয়। গোপালগঞ্জ কারাগারের জেলার আবু সায়েম, রাজবাড়ী সদরে সেনাবাহিনীর মেজর অব.শাকিল হোসেনসহ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৫টি গাড়ী ঈদযাত্রায় দূর্ঘটনার কবলে পড়ে, এতে ২১ পুলিশ সদস্য ও ১০ সেনা সদস্য আহত হয়। একই সময়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও সাভারে ২টি বাস ডাকাটির ঘটনা ঘটে এতে অন্তত ২২ জন আহত হয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায় সংগঠিত দূর্ঘটনার ৭২ টি মুখোমুূখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, এতে ১১২ জন নিহত ও ৫৫৭ জন আহত হয়। ২৭ টি বাস চাপার ঘটনায় ২৯ জন নিহত ২০ জন আহত হয়। ২০টি পরিবহন নিয়ন্ত্রনহারিয়ে খাদে পড়ে ৩৪ জন নিহত ২৬৪ জন আহত হয়। ৮টি ট্রাক চাপার ঘটনায় ৮ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়। এছাড়াও নানা কারনে সংগঠিত ৮৩টি দূর্ঘটনায় ৮২ জন নিহত ও ২৬৮ জন আহত হয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে (১) অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো (২) বিপদজনক ওভারটেকিং (৩) সড়ক মহাসড়কে রোড ডিভাইডার না থাকা (৪) ট্রাফিক আইন না মানা (৫) চালকের বেপরোয়া মনোভাব (৬) প্রশিক্ষণ বিহীন অদক্ষ চালক (৭) রাস্তার ক্রটি (৮) যাত্রী সাধারণের অসচেতনতা (৯) অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন (১০) ধীরগতির পশুবাহী ট্রাক, নছিমন-করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক, অটোরিক্সা, ব্যটারিচালিত রিক্সা, প্যাডেলচালিত রিক্সার সাথে বাণিজ্যিক টিপধারী দ্রুতগতির বাস ও মাইক্রোবাস, কার একইসাথে চলাচল (১১) যানবাহনের ক্রটি (১২) ফিটনেস বিহীন, নিবন্ধন বিহীন ও অবৈধ যানবাহন মহাসড়কে উঠে আসা (১৩) নগরীতে চলাচলরত প্রাইভেট কার, জিপ, এবং সিটি সার্ভিসের বাস দূরপাল্লার মহাসড়কে চলাচল (১৪) সড়ক ব্যবহারকারীদের সড়ক ব্যবহার আইন কানুন সম্পর্কে অজ্ঞতা (১৫) যানজটে আটকে থাকা বাণিজ্যিক টিপধারী পরিবহনগুলোকে অতিরিক্তি মুনাফার আশায় দ্রুত ফেরত আসার জন্য মালিক পক্ষের বারবার তাগাদা (১৬) মোবাইলে কথা বলে যানবাহন চালানো (১৭) মোবাইলে কথা বলে রাস্তা পারাপার, (১৮) টিনএজদের দ্রুত গতির মোটর সাইকেল (১৯) মহাসড়কের পাশে হাটবাজার (২০) ফুটপাত দখলে থাকায় অথবা ফুটপাত না থাকায় রাস্তার উপরদিয়ে যাতায়াত এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ।
সুপারিশমালা: (১) মহাসড়কে দ্রুত গতি ও ধীর গতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনের ব্যবস্থা করা (২) প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে দূর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা (৩) রাস্তার রোড সেফটি অডিট নিয়মিত করা (৪) সড়ক মহাসড়কে রোড ডিভাইডার স্থাপন করা (৫) প্রশিক্ষিত চালক গড়ে তোলা (৬) ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে মানসম্মত পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা (৭) পাঠপুস্তকে সড়ক ব্যবহার আইন অর্ন্তভূক্ত করা (৮) ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু আধুনিকায়ন করা, (৯) নছিমন-করিমন বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া (১০) ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া (১১) ঈদে বিভিন্ন শিল্পে রেশনিং পদ্ধতিতে ছুটির ব্যবস্থা করা (১২) যানবহানের ফিটনেস পদ্ধতি ডিজিটাল করা (১৩) সড়ক দূর্ঘটনার মামলা তদন্তে পুলিশ বাহিনীতে আলাদা ইউনিট গঠন করা (১৪) যাত্রী সচেতনতা সৃষ্টি করা (১৫) মালিককর্তৃক প্রতিদিন গাড়ী রাস্তায় নামার পূর্বে ফিটনেস পরীক্ষা করা।
এই সময় উপস্থিত ছিলেন, দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা কাজী মাসুদ আহম্মেদ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি রুস্তম আলী খান, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনিষ্টিটিউট, বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোঃ সাইফুন নেওয়াজ, বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিক্যালের সভাপতি ও বারডেম হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের প্রফেসর ডাঃ হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির আইন উপদেষ্টা ব্যরিষ্টার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, নিরাপদ সড়ক চাই যুগ্ন মহাসচিব গণি মিয়া বাবুল, নিরাপদ নৌ-পথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব আমিনুল রসূল বাবুল , যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দূর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্য মো.সামসুদ্দীন চৌধূরী, এম মিলাদ উদ্দিন মুন্না প্রমূখ।