ফন্ট সাইজ

শেয়ার করুন

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print

ওসি প্রদীপের ‘জলসা ঘর’ ও বিকল্প থানা (ভিডিও)

.

সংবাদটি পড়তে সময় লাগবে মিনিট

.

থানা থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের নাজিরপাড়া গ্রাম। এ গ্রামের নূর মোহাম্মদের বাড়িটি ছিল ওসি প্রদীপের ‘জলসা ঘর’। মাদকের আসর সহ অনৈতিক নানা কাজের কেন্দ্র ছিল ওই বাড়িটি। শুধু কি এসব, এ বাড়িতে বসেই ওসি প্রদীপ মামলা নিতেন। জোর করে চেকে স্বাক্ষর নেয়া, আসামি ধরা, ছাড়া এসব চলতো এ বাড়িতে। এখানে থাকতেন ওসি প্রদীপের ঘনিষ্ঠ পুলিশ সদস্যরাও। ওই বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে আরেক থানা হিসেবেই পরিচিত।বাড়িটিকে প্রদীপ গড়ে তুলেছিলেন বিকল্প থানা হিসেবে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা হত্যা ঘটনার পর ২রা আগস্ট রোববার সন্ধ্যায় থানার পুলিশ সদস্যরা বাড়িটি ছেড়ে চলে যান। সঙ্গে করে নিয়ে যান বাড়ির ভেতরের আসবাবপত্র। গতকাল সরজমিন দুই তলাবিশিষ্ট বাড়িটিতে দেখা মিলে থানা পরিচালনা করার আলামত। বাড়িটির নিচ তলায় হাতের ডান পাশের কক্ষটিতে দেখা যায় মামলার অসংখ্য গুরুত্বপূর্র্ণ কাগজপত্র। দু’তলায় মিলে মদের বোতল, ইয়াবা খাওয়ার সরঞ্জাম, পুলিশ সদস্যদের জুুতা, মদের বোতল, ব্যাংকের খালি চেক, আর্মড পুলিশের পোশাকসহ পুলিশ সদস্যদের থাকার নানা আলামত।

.

অভিযোগ রয়েছে, বাড়িটির মালিক মুদি দোকানি নূর মোহাম্মদকে গত বছর দোকান থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ার দেয় টেকনাফ থানা পুলিশ। নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম অভিযোগ করে বলেন, স্বামী নূর মোহাম্মদকে গত বছর মার্চ মাসে বাড়ির পাশে দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় টেকনাফ থানা পুলিশ। পরে তাদের কাছ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা দাবি করেন পুলিশ সদস্যরা। পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি আমার স্বামীর। তাকে তারা ক্রসফায়ার দিয়ে দেয়। ঘটনার দুই মাস পরে এখান থেকে আমাদের বের করে দেয়া হয়। বাড়ি থেকে আমাদের কিছুই নিতে দেয়া হয়নি। পরে ওসি প্রদীপ কুমারকে দলিল দেখালে দলিলটিও তারা নিয়ে নেয়।

অভিযোগ রয়েছে, নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগমকে তার দুই সন্তান সহ বাড়ি থেকে বের করে দেন ওসি। এরপর থেকে বাড়িটি দখলে নেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। নিজের বাড়ি থাকতেও লায়লা বেগম মানুষের বাড়িতে বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

লায়লা বেগম বলেন, আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। তারপরও তাকে তারা বিনা কারণে মেরে ফেলে। নূর মোহাম্মদের মা আবেদা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আজকে আমার ছেলে নেই। ওসি প্রদীপ আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে, টাকাও নিয়েছে। তখন যদি বলতো বাড়িটি দিয়ে দেয়ার জন্য দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার ছেলেকে মারতে দিতাম না। এখন খুব বিপদে আছি। ছেলে বউ আর নাতিরা থাকার সমস্যায় ভুগছে।’

জলসা ঘরে ওসি প্রদীপ

এদিকে এই বাড়িটি ওসি প্রদীপের নির্যাতন সেল হিসেবে পরিচিত ছিল। নীরিহ মানুষকে টার্গেট করে ধরে নিয়ে এসে এখানেই প্রথমে রাখা হতো তাদের। করা হতো নির্যাতন। তারপর তাদের সঙ্গে চলতো দেন-দরবার। টাকা না দিলে দেয়া হতো ক্রসফায়ার, দিলেও দেয়া হতো ক্রসফায়ার। তবে সুবিধা করতে না পারলে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হতো মূল থানায়। পরে ইয়াবা বা অস্ত্র দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হতো।

এলাকাবাসীরা গণমাধ্যমকে জানান, প্রায় সময় রাতের বেলায় কান্নার শব্দ পেতেন বাড়ির আশেপাশের লোকজন। তেমন একজন এই এলাকার বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশেষ করে মধ্যরাতে অনেকের কান্নার শব্দ আমরা এখানে শুনতাম। পুলিশের গালাগালি শুনতাম। কিন্তু তখন আমরা ভয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতাম না। এই বাড়ির আশেপাশেও কেউ যেতো না। ওসি প্রদীপ নিয়মিত এখানে এসে অফিস করতেন। আমরা তা দেখেছি। যখন তিনি আসতেন এলাকার মানুষ তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপতো। তার সামনে ভুলেও কেউ পড়তেন না।

আনসারের পোষাক।

জানা গেছে, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের একটি অপারেশন টিম ছিল। সেই টিমের সদস্যদের মূল আস্তানা ছিল ওই বাড়িটি। টিমের মধ্যে ছিল বেশ কয়েকজন এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল। তাদের মধ্যে এসআই সঞ্জিত দত্ত ছিল ওসি প্রদীপের সেকেন্ড ম্যান। সকল কিছুর দেখভাল করতেন তিনি। দেন-দরবারও হতো তার মাধ্যমে। ওসির সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকতেন এসআই রুবেল দাশ, কনস্টেবল সাগর দেব, এসআই মিঠুন ভৌমিক। এই তিনজনকে নিয়ে চলতেন তিনি। টেকনাফ থানার শাহ্‌পরীর দ্বীপ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ দিপক বিশ্বাস ছিলেন ওসি প্রদীপের ভাগিনা। এসআই সুবির পাল, কামরুজ্জামান, মশিউর রহমান (হোয়াইক্যং ফাঁড়ির) ইনচার্জ। অভিযোগ রয়েছে, তিনিই সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ার দিয়েছেন টেকনাফ থানা এলাকায়। ওই বাড়িটির অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিল এএসআই ফখরুল। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে নূর মোহাম্মদের বাড়ির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাকে সেখানকার ইনচার্জ বলা হতো। বাকি সদস্যরা এই থানায় তাদের অপকর্মগুলো ঘটাতো। আরো একজন উল্লেখযোগ্য ছিল এসআই নাজিম। টেকনাফ থানার বিভিন্ন ফাঁড়ির ইনচার্জরা এখানে এসে যোগ দিতেন জলসায়। পুলিশের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বৈঠক হতো এখানে। এসব বৈঠকে যোগ দিতেন এলাকার মাদক কারবারিরা। শুধু তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে, ক্রসফায়ারের যেসব গোপনীয় তালিকা করা হতো সেগুলোও হতো এখানে।

প্রদীপের এই জলসা ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন একজন ভুক্তভোগী ফরিদা বেগম ওরফে কাজল। চলতি বছরের শুরুতে মাদক চোরাচালানের অভিযোগে এই নারীসহ তার ভাই আবদুর রহমান এবং স্বামী আবদুল কাদেরকে আটক করেছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাস। দুইদিন ওই বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতনের পর ফরিদা বেগম ওরফে কাজলকে ইয়াবা দিয়ে কোর্টে চালান দেয়া হয়। তবে বাঁচতে পারেননি কাজলের ভাই আবদুর রহমান এবং কাজলের স্বামী আবদুল কাদের। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পড়েও কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন তারা। আরেক ভুক্তভোগী টেকনাফের পুরান পল্লান পাড়ার বেলুজা ও আমিনা খাতুন বলেন, ৫ই জুলাই দিনদুপুরে টেকনাফ থানা পুলিশের এএসআই নাজিমের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘরে ঢুকে আমিসহ ঘরের লোকজনকে ব্যাপক মারধর করে। এরপর আলমিরা ভেঙে দুই ভরি স্বর্ণ, দেড় লাখ টাকা ও জায়গা জমির কাগজপত্র লুট করে। এসময় তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে টেনেহিঁচড়ে পরিবার সদস্য কবির আহমদসহ তাদেরকে থানায় নিয়ে মারধর করে। পরে তাদের ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়েও তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে ‘তাদের ছেড়ে দেয়ার নামে নগদ দুই লাখ টাকা ঘুষ নেয় পুলিশ অফিসার নাজিম। তবে ১শ’ পিস করে ইয়াবা দিয়ে কারাগারে চালান দেয়। দেড় মাস কারাভোগ শেষে দুজন জামিনে বেরিয়ে আসলেও এখনো কারাভোগ করছে পরিবারের আরেক সদস্য কবির।

কথিত ওই থানার পাশের বাড়ির বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন শাবু। তিনি থানা যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তাকেও ডেকে নিয়ে আটক করে এসআই নিজাম উদ্দিন। তাকে পাশের বাড়ির কথিত থানায় না নিলেও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মূল থানায়। সেখানে থানার তিন তলায় তাকে দুইদিন আটকে রেখে টাকা দাবি করেন। পরে পাঁচ লাখ টাকা দিলেও তাকে পাঁচ শ’ ইয়াবা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই থানার পাশের বাড়ির আব্দুল আমিন ৮ নং ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। টেকনাফ বাজারের নিউমার্কেট এলাকায় তাদের পারিবারিক দোকান থেকে তাকে আটক করেন এসআই ফকরুল। পরে তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে দুই লাখ টাকা দেয়ার পরে তাকেও পাঁচ শ’ ইয়াবা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। জানা গেছে, ওই কথিত থানার বিষয়টি নিয়ে তারা প্রতিবাদ করলে পুলিশের রোষানলে পড়েন তারা।

জলসাখানায় মদের বোতল।

অভিযোগ রয়েছে, কথিত ওই থানার পুলিশ টিম টেকনাফের প্রায় দুই হাজার দোকানে ফুলের টব দেয়ার নাম করে সাত শ’ টাকা করে চাঁদা নিয়েছিলো। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন শ’ টাকা করে ফুলের টব সরবরাহ করলেও বাকি চার শ’ টাকা তারা লুটপাট করেছে। এমন অনেক অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, টেকনাফ থানার কথিত ওই থানার সদস্যদের বলা হতো ‘ওসির টিম’। এই টিমে থানার কয়েকজন কর্মকর্তাসহ পুরো থানা এলাকাজুড়ে অনেক সোর্স জড়িত রয়েছে। এই টিমের সদস্যরা ওই বাড়িটিকে দখল নিয়ে অবৈধ কার্যক্রম চালাতো। এই টিমের নেতৃত্বে মূল থানার তিন তলায় ‘টর্চার সেল’ পরিচালনার অভিযোগও করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। তবে ওই বাড়িটিই ছিল তাদের প্রধান টর্চার সেল।

অভিযোগ রয়েছে, এই টিমের সদস্যরা কোনো অভিযানে গেলে পুলিশের কোনো গাড়ি ব্যবহার করা হতো না। ব্যবহার করা হতো সাদা ও কালো গ্লাসের মাইক্রোবাস। এসব অভিযানে আটককৃতদের নিয়ে আসা হতো এই বাড়িটিতে এবং নিয়ে যাওয়া হতো মেরিন ড্রাইভসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এপিবিএন পুলিশের একটি ক্যাম্পও ছিল এই বাড়িতে। বাড়িটির মালিক নূর মোহাম্মদের ছোট ভাই নাঈম ইসলাম নূরু গণমাধ্যমকে বলেন, এখানে পুলিশের বিশেষ শাখা এপিবিএন সিটিজির একটি টিমও থাকতো।

তিনি বলেন, টেকনাফ থানার পুলিশ সদস্যরা থানা থেকে এখানে রান্না করে নিয়ে আসতো। তার কথার সূত্র ধরে সরজমিন এই তথ্যের প্রমাণ মিলে। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, এপিবিএন পুলিশের প্রতিদিনের কার্যক্রমের একটি রুটিন টানানো আছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহার মৃত্যুর পরে রোববার সন্ধ্যায় টেকনাফ থানা পুলিশ সদস্যরা (ওসির টিম) ও এপিবিএন পুলিশ টিম তড়িঘড়ি করে বাসাটি ছেড়ে দেয়। এখন পুরো বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। উৎসুক জনতা বাড়িটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন।

টেকনাফ থানায় গেলে থানার ওসি (অপারেশন) রাকিবুল ইসলাম খান বিষয়টি স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, এটা ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়ি। এটা আদালতে ক্রোক করার নির্দেশ আছে। আমরা এখানে কয়েকদিন ছিলাম। আর্মড পুলিশও ছিল, পরে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়ার পরে আমরা চলে আসি। টেকনাফ থানার সদ্য যোগদান করা ওসি মো. আবুল ফয়সল গণমাধ্যমকে বলেন বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে এমনটা হয়ে থাকলে খুব খারাপ হয়েছে।  সূত্র: মানবজমিন

সর্বশেষ

ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে চট্টগ্রামে বিআরটিএ’র বিশেষ অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা হয়নি: প্রেস সচিব

সিরিয়ার ঋণ শোধ করবে সৌদি-কাতার

ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ

প্রথম চুয়েটের রিফাত আল ইব্রাহিম ⦿কেএসআরএম অ্যাওয়ার্ড পেলেন তিন ভবিষ্যৎ স্থপতি

ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আগ বাড়িয়ে মধ্যস্থতা করতে চায় না বাংলাদেশঃ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সন্ধ্যায় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে প্রথমবারের মতো উড়াল দেবে কার্গো ফ্লাইট

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print