ফন্ট সাইজ

শেয়ার করুন

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print

স্বাধীনতা সংগ্রামে মাওলানা ভাসানীর অবদান

সংবাদটি পড়তে সময় লাগবে মিনিট

কবি মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর এদেশের কৃষক শ্রমিক শোষিত বঞ্চিত মেহনতি মানুষের জন্য এক শোকাবহ বেদনা বিধুর দিন। এদিন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরলোক গমন করেন। লক্ষ লক্ষ ভক্ত অনুসারীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে অনন্ত পথের যাত্রী হন। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় সিপাহসালার। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বললেও অত্যুক্তি হবেনা। তিনি ছিলেন সম্রাজ্যবাদ, পুজিবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক। অগ্নিমশাল জ্বেলেছিলেন কৃষক শ্রমিক দিন মজুর সহ খেটে খাওয়া মানুষের ঘরে ঘরে, সে লেলিহান শিখায় প্রকম্পিত ছিল সম্রাজ্যবাদ ও অধিপত্যবাদী গোষ্ঠির মসনদ।

%e0%a6%ae%e0%a6%93%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%80
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।

শৈশবকালে তিনি তাঁর চাচা ইব্রাহীমের তত্ত্বাবধানে থেকে মক্তবে লেখাপড়া শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি তার জন্মভূমি সিরাজগঞ্জে ধানগড়া পল্লীতে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ইতিবৎসরে জয়পুর হাট জেলাধীন পাঁচবিবি থানার অন্তর্গত জমিদার শামসুদ্দীন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়ীতে গৃহশিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৭ সাল হতে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। ফলশ্র“তিতেই দেওবন্দী আলেমদের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তাতে তার জীবনকে প্রভাবিত করে। দেওবন্দ হতে তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯০৯ সালে কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। ইতিপূর্বে ১৯০৬ সালে ঢাকার মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হলে তিনি তাতে সম্পৃক্ত না হয়ে বরঞ্চ করমচাঁদ মোহনলাল গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সক্রীয় সমর্থক ও কর্মী ছিল।

এথেকেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে তিনি দেওবন্ধ মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেও ধর্ম্মান্ধ ছিলেন না বরঞ্চ তিনি ছিলেন আজন্ম একজন খাটি মুসলিম ও অসম্প্রদায়িক চরিত্রের মানুষ। তিনি ছিলেন উদারপন্থি প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার অনুসারী, ধর্ম্মীয় সংকীর্নতা, গোড়ামি বা কুসংস্কার তার জীবনে প্রশ্রয় পায়নি। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক বা পুথিগত শিক্ষার চেয়েও প্রাকৃতিক শিক্ষায় ও মনস্তাত্বিক শিক্ষায় বেশী শিক্ষিত ছিলেন। ফলে তিনি সেসময় তার সামাজিক, আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক, পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তিনি তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সস্মৃক্ত হয়। উল্লেখ্য যে ১৯১৭ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নে অর্থাৎ রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ১৯৪৯ সালে চীনের গণবিপ্লব বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ইত্যাদি তার জীবনে ঐতিহাসিক গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। তিনি ছিল প্রগাঢ় ব্যক্তিত্ব, দুরদর্শী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ।

তাই তিনি ১৯১৭ সালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল যে তিনি মুসলিম লীগের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে খেলাফত আন্দোলন ও গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং দশ মাস কারাভোগ করেন। অনুরূপ ভাবে করমচাঁদ গান্ধী ও অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি খেলাফল আন্দোলনকেও সমর্থন দেন। তখনকার মুসলিম লীগ ব্যতিত অন্যান্য ছোটখাট সংগঠনের মুসলিম মনিয়ীদের ও একই ভূমিকা ছিল। যেমন চট্টগ্রামের নেতা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী প্রমুখ।

১৯১৯ সাল হতে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ভারতের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই কোন কোন মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাম্রদায়িক রাজনৈতিক প্রসুত দল গঠনে বা দলবদলের ঘটনা সমূহ তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ তখনকার রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্তিরতা সৃষ্টির পায়তারা চলে সুকৌশলে। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। এরপর হতে তিনি মূলত ১৯৪৪, ১৯৪৫ সালের দিকে পাকিস্তান নামক স্বাধীন ও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের জন্য তৎপর হন।

১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টির পর সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চিন্তা চেতনা ভিন্নখাতে ভিন্ন মাত্রায় প্রবাহিত হতে থাকে, ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটতে থাকে। ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ইতিব্যসরে বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটে, সেসঙ্গে ধর্ম্মনিরপেক্ষ মতবাদকে সুকৌশলে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। ফলে আওয়ামী মুসলীম লীগ ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হতে থাকে। এছাড়াও ১৯৫৪ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বার গোড়াপত্তন করে, এমনি এক রাজনৈতিক স্রোতধারার আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়।

মাওলানা ভাসানী একজন আপাদমস্তক মুসলিম হয়েও মুসলিম শব্দটা বাদ দিয়ে তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটায়। তার নেতৃত্বে একই বৎসর পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট (হক ভাসানী) বিপুল ভোটে জয়ী হয়। পরবর্তীকালে উক্ত নির্বাচন বাতিল হয়ে গেলে মুসলিম লীগ হয়ে যায় টুটু জগন্নাথ এবং মুসলিম লীগকে যাদুঘরে প্রেরণ করা হয় ।

তিনি ছিলেন কুষক শ্রমিক সর্বহারা মেহনতি মানুষের নেতা, আজীবন শোষক, সামন্তবাদী ও সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক। তার দৈনন্দিত জীবনে খাওয়া দাওয়া পোষাক পরিচ্ছেদ চলাফেরা, কথাবার্তায় ছিলেন একেবারে অতি সাধারণ মানুষের ন্যায়।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী ও সেক্রেটারী হন সামসুল হক।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর পরই তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের বেড়াজাল সৃষ্টি হচ্ছে। কায়েমী স্বার্থবাদী নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্টির স্বার্থ উপেক্ষা করে তাদের ন্যায্য হিসাব থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই তিনি ১৯৫৭ সালের কাগমারীতে কৃষক সম্মেলনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শোসকগোষ্ঠিকে আচ্ছালামু, আলাইকুম বলে পৃথক জাতি সত্তার ইঙ্গিত প্রদান করেন।

মাওলানা ভাসানী তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করেছেন যে বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও বর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি গোষ্ঠির পক্ষে শোষিত বঞ্চিত কৃষক শ্রমিক মজুরের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় যা আমরা প্রতি মুহুর্তে উপলিব্ধি করছি। তাই তিনি এদেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। সে হতে তার নামের আগে ভাসানী যোগ করা হয়। এরপর ১৯৩১ সালে কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩ সালে গাইবান্দায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করে এবং সেসময়কার শাসকদের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ যে, তিনি শুধু রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না তিনি ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক ও ধর্মীয় আধ্যাত্মিক গুরু। তাই তিনি সন্তোষে নিজ উদ্যোগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। এছাড়াও দেশব্যাপী তার হাজার হাজার ভক্তমুরীদ রয়েছে।

১৯৫২ সালে ৩০ জানুয়ারী ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পরার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ১৬ মাস কারা ভোগের পর ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল তিনি মুক্তি পান গণআন্দোলনের মাধ্যমে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ যে, ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতারকৃত শেখ মুজিবুর রহমান এর মুক্তির দাবিতে দুর্বার গণ আন্দোলন শুরু করেন। ফলশ্র“তিতে পাক সামরিক বাহিনী তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

প্রতি মুর্হুতে উপলব্ধি করছি আজো ক্ষেতে খামারে, কলকারখানায় কৃষক শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামেই লিপ্ত হয়ে বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিতে হয়। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রকৃত অর্থে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার কেউ নেই। কারণ বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রিয় কাঠামোতে কায়েমি স্বার্থবাদী নেতৃত্বের ফলে সেখানে শোষিত ও নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেনা। তাই আজকের দিনে মরহুম জননেতা, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মত সৎ, নির্লোভ ও আজীবন সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক নেতার বড় প্রয়োজন। কাজেই আসুন আমরা মাওলানা ভাসানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দারিদ্রমুক্ত ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, পুজিবাদ, জঙ্গিবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর শপথ গ্রহণ করি। সে সঙ্গে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক :
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি ও প্রাবন্ধিক।

 

সর্বশেষ

ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে চট্টগ্রামে বিআরটিএ’র বিশেষ অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা হয়নি: প্রেস সচিব

সিরিয়ার ঋণ শোধ করবে সৌদি-কাতার

ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ

প্রথম চুয়েটের রিফাত আল ইব্রাহিম ⦿কেএসআরএম অ্যাওয়ার্ড পেলেন তিন ভবিষ্যৎ স্থপতি

ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আগ বাড়িয়ে মধ্যস্থতা করতে চায় না বাংলাদেশঃ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সন্ধ্যায় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে প্রথমবারের মতো উড়াল দেবে কার্গো ফ্লাইট

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print