
চট্টগ্রাম মহানগরীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অপরিকল্পিত থাবা থেকে অনেক ইতিহাসের স্মৃতিস্মারক প্রাকৃতিক নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত টাইগারপাসকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছে চট্টগ্রাম ঐতিহ্য রক্ষা পরিষদ।
আজ রবিবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবী তোলা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিপ্লবের তীর্থস্থান চট্টগ্রামের রয়েছে অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস- ঐতিহ্য। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও প্রাকৃতিক এই ঐতিহ্য আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই টাইগারপাসের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য টাইগারপাস যেন তার আদিরূপে থাকে আমরা সেই আকুতিই জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্যে ঐতিহ্য রক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব সাংবাদিক-লেখক জসীম চৌধুরী সবুজ সিআরবি রক্ষা আন্দোলনের সাথেও সংহতি -একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, চট্টগ্রামের প্রাচীন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সকল ঐতিহ্য রক্ষায় পরিষদ সোচ্চার থাকবে। তবে এই মূহুর্তে টাইগারপাসকে আদিরূপে রক্ষা করাটা চট্টগ্রামবাসীর নৈতিক দায়িত্ব। আশা করছি সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনায় নেবে।
এতে বক্তব্য রাখেন পরিষদের কো- চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া।
সমন্বয়কারী এইচ এম মুজিবুল হক শুক্কুরের সঞ্চালনায় অনুষ্টানে উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম সদস্য সচিব স্থপতি আশরাফুল ইসলাম শোভন, সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, অধ্যাপক মুহম্মদ আমির উদ্দিন, সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ নজরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, সাংবাদিক আবসার মাহফুজ, এ কে জাহেদ চৌধুরী, হাসান মারুফ রুমী, সরোয়ার আমিন বাবু, নুরুজ্জামান, দীপ্তি দাশ,আবদুস সবুর খান, দিলরুবা খানম,আহমদ কবির প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তৎকালীন ভারতবর্ষে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম মহাশক্তিধর ব্রিটিশদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষন- বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপন করা হয়েছিল এই চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দান থেকে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনাও প্রচার হয়েছিল এই চট্টগ্রাম থেকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সমরদপ্তর সিআরবি হিল। এখানে একসময় আসাম- বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তরসহ অনেক বিদেশী প্রতিষ্টান ছিল। একে একে সব বিদেশী প্রতিষ্টান এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সদর দপ্তরও চট্টগ্রাম থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। এভাবে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ঐতিহ্য আমরা হারিয়েছি। সুজলা- সুফলা, শস্য শ্যামলা এই বাংলায় চট্টগ্রাম অনন্য বৈশিষ্ট নিয়ে এখনও অপরূপ হয়ে আছে প্রকৃতির অপার দান পাহাড়- নদী – সাগরের কল্যানে। সেই প্রাকৃতিক ঐতিহ্যও আমরা ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি বলে আগামীর চট্টগ্রামের চেহারা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা গভীরভাবে শঙ্কিত ও উদ্ধিগ্ন।
তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তার সরকার চট্টগ্রামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘ বঙ্গবন্ধু টানেল’ নির্মানের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। এরসাথে সংযুক্ত পতেঙ্গা- ফৌজদারহাট মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হয়েছে। প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ চলছে। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার এবং মুরাদপুর- বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। দোহাজারী- কক্সবাজার রেললাইন, পতেঙ্গায় বে- টার্মিনাল, মাতারবাড়ীত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও গভীর সমূদ্র বন্দরসহ হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যা বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব ও পরিধি আরও বহুগুন বেড়ে যাবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ( সিডিএ) বাস্তবায়নাধীন বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মানকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে এটি আর একটি মাইলফলক হিসেবে সংযোজিত হবে।
তবে, পরিবেশ- প্রকৃতি এবং ইতিহাস- ঐতিহ্য রক্ষার একান্ত তাগিদ থেকে টাইগারপাসের প্রকৃতি প্রদত্ত অপরূপ নান্দনিক সৌন্দর্য যেন ইট- পাথরের কংক্রিটের নিচে ঢেকে না পড়ে। টাইগারপাস মোড় থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত অংশটুকু প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী এই টাইগারপাসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপে রক্ষা পেতে পারে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শেষ প্রান্তটি টাইগারপাসের পরিবর্তে দেওয়ানহাট ব্রিজের দক্ষিন প্রান্তে নামানোর প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, তাহলে আমাদের ঐতিহ্যের টাইগারপাস যেমন রক্ষা পাবে তেমনি ১০০০ কোটি টাকার মত প্রকল্প ব্যয়ও সাশ্রয় হবে। একইসাথে বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে তিনি বলেন, দেওয়ানহাট মোড় থেকে নৌবাহিনী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যে পুরানো রাস্তাটি আছে (দেওয়ানহাট ব্রিজ হওয়ার পর যেটি বন্ধ রাখা হয়েছে) তা আবার চালু করে সেখানে রেললাইনের উপর ওভারপাস তৈরি করলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নেমে যানবাহন এই ওভারপাস হয়ে টাইগারপাস অতিক্রম করবে। বিদ্যমান রেলওয়ে ব্রিজটির যেহেতু মেয়াদ শেষ তা ভেঙ্গে সেখানেও নতুন করে আর একটি ওভারপাস তৈরি করা হলে সেটি দিয়ে আগ্রাবাদমুখী যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ফ্লাইওভারটি যদি টাইগারপাসের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তা হবে খুবই বিপজ্জনক। ধনিয়ালাপাড়া থেকে মনসুরাবাদের দিকে যে ফ্লাইওভারটি গেছে তার উপর দিয়ে আনতে হবে লালখান বাজারমুখী ফ্লাইওভারটি। এতে এটি আনতে হবে ৮০ ফুট উচ্চতায়। ব্যস্ততম এই রুটে যেখান দিয়ে বন্দর থেকে পণ্যবাহী যানবাহনও চলাচল করে সেসব যান এত উঁচুতে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনার শিকার হবে। ব্যস্ততম রুটে যান চলাচল বারেবারে বিঘ্নিত হবে।
এখানে উদাহরন হিসেবে তিনি বলেন, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের যে লুপটি ষোলশহর ২ নং গেট থেকে বায়েজিদের দিকে নেমে গেছে সেখানে ওটার মুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ” ভারী যানবাহন ওঠা নিষেধ” লেখা ফলক সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে উচ্চতায় সেখানে ভারী যানবাহন উঠতে পারছে না তার চেয়েও বেশি উচ্চতায় দেওয়ানহাট- টাইগারপাস ফ্লাইওভারে কিভাবে উঠবে? ভারী যানবাহনই যদি চলাচল না করতে পারে তাহলে সেই ফ্লাইওভার কেন?
ঐতিহ্য রক্ষা পরিষদ নেতৃবৃন্দ বলেন,টাইগারপাস এলাকায় ফ্লাইওভার তৈরি করে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন চট্টগ্রামবাসী। চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও এই জায়গায় ফ্লাইওভার না করতে নকশা পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়েছেন সিডিএকে। যা নগরবাসীর প্রানের দাবি।