
খুলনার মেয়ে দৌলতপুরের শম্পা (১৯)। স্থানীয় একটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন তিনি। সেখানে রেজাউল করিম স্বপন নামে এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয় তার। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আড়াই বছর ধরে ছিল প্রেমের সম্পর্ক।
পরে বিয়ে না করেও স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ভাড়া বাসা নিয়ে একসঙ্গে সংসার করেছেন তারা। এরপর বিয়ের জন্য চাপ দিলে শুরু হয় মনোমালিন্য। অতপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় শম্পাকে। শুধু তা-ই নয়, লাশ গোপন করতে ট্রাঙ্কে ভরে লাশ চট্টগ্রাম থেকে তুলে দেয়া হয় তুলে দেয়া হয় ঢাকার বাসে।
প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৫ সালের ৩ মে এমনই ঘটনা ঘটেছিল। দীর্ঘ সময় তদন্ত করে ঘটনায় অভিযুক্ত রেজাউল করিম স্বপনকে গতকাল গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
পুলিশ জানায়, ২০১৫ সালের ৩ মে ভোরে চট্টগ্রামের এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কেটে শম্পার লাশ একটি ট্রাঙ্ক ভরে বাসের লাগেজ বক্সে তুলে দেন কথিত স্বামী নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রেজাউল করিম। তিনি বাসের হেলপারকে বলেন, সামনে ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে একজন যাত্রী উঠবেন। এটি তার ট্রাঙ্ক। তিনি এটি বুঝে নেবেন। তবে ট্রাঙ্কটি কেউ বুঝে নেয়নি। বিকেলে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলে যাত্রীরা নেমে গেলেও ট্রাঙ্কটি পড়ে থাকে। পরে বাসের হেলপার ট্রাঙ্ক খুলে এক নারীর লাশ দেখতে পায়। পুলিশকে খবর দেয়া হলে লাশ উদ্ধার করে দারুস সালাম থানা পুলিশ। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় শম্পার লাশ। কেউ বাদি না হওয়ায় দারুস সালাম থানা পুলিশের পক্ষে এসআই জাহানুর আলী বাদি হয়ে আসামি ‘অজ্ঞাত’ উল্লেখ করে একটি মামলা করেন।
ঘটনার ছয় বছর পর গত শুক্রবার ভোরে কুমিল্লার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে শম্পা হত্যার একমাত্র আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তারা জানায়, আসামি রেজাউল করিম দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে।
শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, রেজাউল করিম স্বপন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য। খুলনার তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত থাকার সময় শম্পা বেগম হাসপাতালের মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। তখনই শম্পা বেগমের সাথে রেজাউলের পরিচয় হয়। গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। পরে শম্পা বিয়ের জন্য চাপ দিলে আসামি স্বপন বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে যায়। তখন শম্পাও চট্টগ্রামে চলে যায়।
তারা বিয়ে না করেই পাহাড়তলী থানার উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়িতে বসবাস করা শুরু করেন। সেখানে থাকার সময় নানা বিষয় নিয়ে কলহের জেরে স্বপন শ্বাসরোধ করে হত্যা করে শম্পাকে।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, স্বপন যে বিবাহিত সেটি শম্পা জানতেন না। ৩ জুন বিয়ের কথা নিয়ে যখন সমস্যা হয় তখন শম্পার গলার উড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানান তিনি। এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে লাশ বাক্সবন্দী করে তুলে দেয়া হয় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী বাসে। পরে গাবতলী বাস টার্মিনালে এলে দারুসসালাম থানা পুলিশ এসে অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ উদ্ধার করে দাফন করে। কুমার মজুমদার জানান, হত্যাকাণ্ডের পর থেকে শুরুতে প্রায় তিন মাস থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। থানা পুলিশের পর সিআইডি চার বছর তদন্ত করে।
কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত এবং হত্যারহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। দাখিল করা চূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দেন। তিনি বলেন, মামলাটি হাতে পাওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা সশরীরে চট্টগ্রামে গিয়ে ২০১৫ সালে এন্ট্রিকৃত ১০-১২টি ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনার জিডি সংগ্রহ করেন। এদের মধ্যে একটি ছিল শম্পা বেগমের। শম্পার লাশ উদ্ধারের কয়েক দিন আগে তিনি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। সেই জিডির সূত্র ধরে পিবিআই তদন্ত শুরু করে। এক পর্যায়ে ঘাতককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তারা শম্পার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ইলিয়াস শেখের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন (অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনী সদস্য) খুলনার তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। আর শম্পা স্থানীয় একটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। সেই হাসপাতালে ইলিয়াস শেখ নামে এক নৌ অফিসারের স্ত্রীর চিকিৎসাকালীন শম্পা বেগমের সাথে রেজাউলের পরিচয় হয়। এরপর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিছুদিন পরই রেজাউল বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। শম্পাও কিছুদিন পর চট্টগ্রামে চলে আসেন। সেখানে তারা একত্রে বসবাস শুরু করেন।
স্থানীয়দের কাছে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকলেও তারা প্রকৃতপক্ষে বিয়ে করেননি। এক সাথে থাকাকালীন দু’জনের মধ্যে নানা বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয়। একপর্যায়ে ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে শম্পাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন রেজাউল। লাশ গোপন করতে তুলে দেন বাসে। পাশাপাশি শম্পার বাবাকে ফোন দিয়ে বলেন, শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেয়া হয়েছে। শম্পা তার বাবার বাড়িতে না পৌঁছলে পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাননি। পরে তার ভগ্নিপতি আব্দুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় ওই জিডিটি করেন।