
চট্টগ্রামের অফুরন্ত সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি যাতায়ত ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষ্য নিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের সরকারি উদ্যোগকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন সংশয়। চাইনিজ প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই নিজেদের খরচে করার প্রস্তাব দিলেও নতুন করে আগ্রহ দেখানো কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোইকা চায় ২৬ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টস লিমিটেড’ চট্টগ্রাম নগরীতে মেট্রোরেলের প্রস্তাব করেছিল। যেখানে তিনটি রুটে ৪৭টি স্টেশনসহ সাড়ে ৫৪ কিলোমিটার রেললাইন করার কথা ছিল।
কিন্তু গেল পাঁচ বছরে পাঁচটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে মেট্রোরেল প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ দেখালেও ফিজিবিলিটি স্টাডির অর্থায়ন, বহৎ এ প্রকল্পের অর্থের যোগান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের টানাহেঁচড়ার কারনে শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিল, দাপ্তরিক চিঠি বিনিময়েই সীমাবদ্ধ ছিল প্রকল্পটির বাস্তবায়ন।
চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি চাইনিজ কোম্পানী সিআরসিসি (চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন গ্রুপ লিঃ) নিজস্ব অর্থে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ২০২১ বছরের ২১ মে। প্রকল্পটি নিয়ে বেশ কিছুদিন প্রাক ফিজিবিলিটির কাজ করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। কয়েক দফা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে এ প্রকল্পের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১৮ জানুয়ারী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলমকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এক চিঠি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাথে (সিআরসিসি) মেট্রোরেল প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি’র এমইইউ স্বাক্ষর করার বিষয়ে সম্মতিও প্রদান করেছিলেন। সেই চিঠিতে মেট্রোরেল প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির ব্যয়ে সিআরসিসি’র প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার কিংবা সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই এই তথ্য উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে এমইইউ সাইনের ঠিক আগে কোরিয়া আগ্রহ প্রকাশ করেছে প্রকল্পটি নিয়ে। কিন্তু বলা হচ্ছে কোরিয়ান কোম্পানি কোইকা একই ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ২৬ কোটি টাকা নেবে, বাকিটা অনুদান দেবে।

লিখিত কোন প্রস্তাব না দিলেও কোরিয়ান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা কোইকা এমআরটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে খরচ ধরেছে ৭৭ কোটি টাকা। অথচ চায়নিজ কোম্পানি সিআরসিসি’র দেয়া প্রস্তাব অনুযায়ী খরচ হবার কথা ৬০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই এই প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে করার কথা।
সিআরসিসি’র লিখিত প্রস্তাবনা পাবার পর গেল বছরের ২৪ জুন চট্টগ্রাম নগরীতে মেট্টোরেল বা মনোরেল চালুর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন সংস্থার সাথে মতবিনিময় করে। সিডিএ, চট্টগ্রাম চেম্বার, পরিবেশ অধিদপ্তর, ট্রাফিক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা সভায় অংশ নিয়ে প্রস্তাবের পক্ষর নিজেদের অভিমত দিয়েছেন।
গেল বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম সিআরসিসি’র (চায়না রেলওয়ে ব্রুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড) দেয়া প্রস্তাবের বিপরীতে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করার অনুমতি চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন। ৩১ অক্টোবর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির প্রাক ফিজিবিলিটি স্টাডি চেয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেয়।
সর্বশেষে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারী মেট্রোরেল বা এমআরটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য সিআরসিসি’র প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর। এতোকিছুর পরও মেট্রোরেল প্রকল্পটি নিয়ে স্পষ্ট কোন ধারনা নেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কিংবা চসিকের।
এ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিজ করার অনুমোদন পাবার পরও কেন এমওইউ স্বাক্ষর করা হলো না এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম বলেন, ‘এমওইউ’র খসড়া আমাদের মতো করে হয়নি বলে সিআরসিসির সাথে এমওইউ করা হয়নি। তারা পুরো প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিজের ব্যয় নিজেদের অর্থায়নে করতে চাইলে ফান্ডিং এর সোর্স আমাদের জানানো হয়নি। এ কারনে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়নি।’ সিআরসিসির প্রস্তাব পছন্দ না হলে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার অনুমোদন চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে চসিকের পক্ষ থেকে কেন চিঠি দেয়া হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে শহিদুল আলম বলেন, এটি মেয়রের পরামর্শ অনুযায়ী করা হয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় নেবে’।
জানতে চাইলে সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আকতার উল কবির বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর সব চেয়ে বৃহৎ এই প্রকল্প নিয়ে নগরবাসীর আগ্রহ রয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি’র কাজ শুরু হবে এমন কথা অনেকবারই আলোচনায় এসেছে। যে কোম্পানিই আগ্রহ প্রকাশ করবে সেটি ইতিবাচকভাবে দেখা যায় যদি সে কোম্পানির দক্ষতা, আর্থিক সক্ষমতা বিশ্বমানের হয়। চায়নিজ প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি রেলওয়ে প্রকল্পের সেক্টরে বিশ্বের বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠান। ফিজিবিলিটি স্টাডি এই প্রতিষ্ঠান যেহেতু নিজের খরচে করার কথা বলেছে, সেখানে ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানের পিছনে কেন সরকার ২৬ কোটি টাকা অপচয় করবে? যদি উন্নত বিশ্বের সক্ষমতা সম্পন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি সিআরসিসি করতে না পারে সেটা ভিন্ন বিষয়। যে প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে তাদেরকেই পুরো কাজ দিতে হবে এমন কোন শর্ত থাকলে ভিন্ন কথা ‘।
এদিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয় দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা কোইকা চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করবে। এতে ৭৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ সরকার বহন করবে। যদিও কোরিয়ান এ প্রতিষ্ঠানটি কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব কিংবা এমইইউ (MOU) স্বাক্ষরের কোন তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি সভায়।
সভায় তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেন, পুরোনো চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাট, চকবাজার, বহদ্দারহাট ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে মেট্রোরেল আন্ডারগ্রাউন্ডে করা যেতে পারে। হয়তো খরচ তিন গুণ বেশি হবে। তবে এটাই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। অন্য এলাকায় ওপর দিয়ে তা করা যেতে পারে।
যদিও প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বিষয়ে লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়নি এখনো। সভায় কোরিয়ার যে কোম্পানির কথা বলা হচ্ছে এটির সক্ষমতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রমতে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারনে কোরিয়ান কোম্পানির সক্ষমতা নেই এতো বড় প্রকল্পের কাজে অর্থলগ্নি করার মতো যদিও ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করার পরই মুলত কারিগরী ও আর্থিক প্রস্তাবনা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির। অন্যদিকে আগে ফিজিভিলিটি স্টাডিসহ অর্থলগ্নীর প্রস্তাব দেয়া চায়নিজ কোম্পানি সিআরসিসি চায়নিজ রেল মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ, কলম্বিয়াসহ উন্নত বিশ্বের সতেরটি দেশে রেলের বৃহৎ কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সম্পুর্ন নিজস্ব অর্থায়নে চায়না প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি’র দেয়া এমআরটি প্রকল্পের প্রস্তাবের বিপরীতে নতুন করে ফিজিবিলিটি স্টাডি জন্য সরকারি অর্থ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এমআরটি প্রকল্পের প্রাক ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছিল। কর্পোরেশনের সুত্রমতে মেট্রোরেল বা মনোরেল প্রকল্পের সেই প্রাক ফিজিবিলিটি স্টাডি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয় নি।
প্রকল্পের উদ্বোধনের আগে প্রকল্পের অর্থায়ন, অনুমোদনের বেশ কিছু ধাপ রয়েছে। যার কোনটিই এখনো পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি। খোদ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোইকা কর্মকর্তারাই বলছেন সমীক্ষার জন্য ১৮ মাস সময় প্রয়োজন। এ প্রকল্প নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শুরু করেনি। সেই হিসেবে আগামী বছরের জানুয়ারীতে মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্বোধনের কথা অবান্তর।
অন্যদিকে চায়না প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি- ডব্লিউআইইটিসি (জয়েন্ট বেঞ্চার) তাদের প্রস্তাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে সাত মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছিল।
এ বিষয়ে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোইকার সাথে কোন ধরনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব জগলুল হুদা জানান, কোরিয়ার আগ্রহ রয়েছে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল প্রকল্প নিয়ে। তবে লিখিত কোন প্রস্তাব তারা এখনো দেয়নি। তাদের অনুকুলে কোন অনুমোদনও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত দেয় নি। বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসিসির প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, মেট্রোরেল প্রকল্প যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিষয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কেন কথা বলবে? সিআরসিসি মেট্রোরেল প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির খরচ যে নিজেরা বহন করার কথা বলেছে সেটা যোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানে না। কোরিয়ান কোম্পানি কোইকা’কে যে ২৬ কোটি টাকা দেয়া হবে তা ঠিক অর্থ নয়, বরং ‘কাইন্ড এক্সসপেনসেস’। যেটি দিয়ে এদেশে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার সময়কালে তাদের যোগাযোগ, বাসস্থান,এন্টারটেইনমেন্ট খরচ নির্বাহ করা হবে। ‘
সংশ্লিষ্ট সুত্রমতে, গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে মেট্রোরেল বা মনোরেল প্রকল্পের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করলেও অর্থায়নের অভাবে প্রকল্পটি শেষ আলোর মুখ দেখেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সিআরসিসি-ডব্লিউআইইটিসি তাদের প্রস্তাবে বিওটিসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রস্তাবনা দেয়ায় এমআরটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে আশার আলো দেখা যায়।
গত ৪ জানুয়ারী একনেক সভায় চট্টগ্রামে মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্দেশনা দেবার কারনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এমআরটি প্রকল্পটি নিয়ে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠে। কিন্তু ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং সিআরসিসি’র এমওইউ (MOU) করার প্রস্তুতির সময়কালে নতুন করে মেট্রোরেল নিয়ে কোরিয়ার আগ্রহের কারনে ভাটা পড়েছে প্রকল্পটি নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দেড় বছরের প্রাক প্রস্তুতি।