
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী, কিংবদন্তী শিল্পী শেফালী ঘোষের দশম মৃত্যু বার্ষিকী আজ। ২০০৬ সালে বছরের শেষ সূর্যাস্তারের সাথে এই গুণী শিল্পী ৬৬ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এর আগে দীর্ঘ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।
শেফালী ঘোষ চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতিকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে তুলে ধরেন যা উপমহাদেশের সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। মাটির গান, মনের গান, প্রেম বিরহের সুরের ইন্দ্রজালে বন্ধি করেন লাখো দর্শককে।

৩ দশকের সঙ্গীত জীবনে কেবলি মুগ্ধ করে গেছেন কোটি শ্রোতার হৃদয়। গেয়েছেন ২ হাজারেরও বেশী আঞ্চলিক ভান্ডারী মারফতি গান।
শেফালী ঘোষ বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে ১৯৪১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর কৃষ্ণ গোপাল ও আশালতা ঘোষ দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তাঁর শৈশব কেটেছে। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন স্তানীয় মুক্তাকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরিবারের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তাঁর গান গাওয়ার ও শেখার সূত্রপাত ঘটে। তাঁর গানের প্রথম ওস্তাদ ছিলেন তেজেন সেন। পরবর্তী ওস্তাদ শিবশঙ্কর মিত্র, জগনান্দ বড়-য়া, নীরদ বড়য়া, মিহির নদী, গোপালকৃষ্ণসহ অনেক সংগীতজ্ঞের কাছ থেকে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন।

শিল্পীজীবনের শুরুতে প্রথমে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত এবং আধুনিক গান করলেও এক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক গান, পল্লীগীতি, মাইজভান্ডারী গান গেয়ে অভাবনীয় শ্রোতপ্রিয় হোন।
তাঁর ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে, ছোড ছোড ঢেউ তুলি/লুসাই পাহাড়ত্তোন লামিয়েরে যারগোই কর্ণফুলী, ওরে সাম্পান ওয়ালা/তুই আমারে করলি দিওয়ানা, তুঁই যাইবা সোনা দিয়া বন্ধু মাছ মারিবাল্লাই’ ইত্যাদি মন ছুঁয়ে যাওয়া জনপ্রিয় গানগুলো তাঁকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

তখনকার সময়ে পাড়া মহল্লার গানের আসর, মেলা, পূজা-পার্বণ ও সামাজিক কর্মকাণ্ড উপলক্ষে নাচ-গান, নাটক, কবিগান, পালাগান, জারিসারি, মুর্শিদী, ভাণ্ডারী, কাওয়ালী কীর্তন ও যাত্রাগানের যেসব আয়োজন হত সেখানে সবার আকর্ষণের মধ্যবিন্দু থাকতেন শেফালী ঘোষ।
তাঁর আরও জনপ্রিয় গানের মধ্যে আছে ‘নাতি বড়ই খা’, ‘ও বানু বানুরে’, ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শিল্পী প্রায় পাঁচ দশকের সংগীত জীবনে প্রায় দুই হাজার গান গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া গান নিয়ে দুই শতাধিকের বেশি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন আঞ্চলিক পরিচালক ১৯৬৩ সালে শেফালী ঘোষ ও আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবকে আঞ্চলিক ভাষায় গান গাইতে প্রস্তাব দিলে দুইজনই রাজি হন এবং তাঁদের দ্বৈত কণ্ঠের গান ব্যপক পরিচিতি লাভ করে। তাঁর মায়াবি কণ্ঠের গান সবাইকে আকর্ষণ করতো। ভরাট গলায় দরদি ও উদার কণ্ঠে গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আর কোন শিল্পী এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কিনা তা বলা দুস্কর। সাম্পান ওয়ালা, মালকাবানু, মধুমিতা, বসুন্ধরা, মাটির মানুষ, স্বামী, মনের মানুষ, বর্গী এলো দেশে প্রভৃতি চলচ্চিত্রসহ প্রায় ২০টি চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাক করেছেন।
সংগীতের পাশাপাশি যাত্রা ও মঞ্চনাটকেও তার নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, কাতার, ওমান, কুয়েত, ভারত, মায়ানমার, বাহারাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ প্রায় ২০টিরও অধিক দেশে তিনি গান গেয়ে চট্টগ্রামের তথা সারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। পেয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক পদক, বাংলা একাডেমি আজীবন সম্মাননা পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, একুশে পদকসহ অর্ধশতাধিক সম্মাননা।
আজ এই মহান শিল্পীর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু গাওয়া হাজারো গান এখনো তাকে বাচিঁয়ে রেখেছেন কোটি মানুষের মনি কোটায়। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে চট্টগ্রামে।
শেফালী ঘোষকে নিয়ে নির্মিত ভিডিও চিত্র