দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষ হতে চলেছে। নিত্যপণ্যের দামের ক্ষেত্রে স্বস্তির রমজান শেষে দুয়ারে সমাগত পবিত্র ঈদুল ফিতর। পশ্চিম দিগন্তে নতুন বাঁকা চাঁদের দেখা পেলেই শুরু হবে ঈদ উৎসব। তবে দেশে এই উৎসবের মধ্যেও এবার চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ যোদ্ধাদের গর্বিত এবং একই সঙ্গে বেদনাবিধুর স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এই ঈদে তাঁদের পরিবার এবং আহত যোদ্ধা, যাঁরা এখনো হাসপাতালে, তাঁদের জন্য এই উৎসব অন্য রকম। গত বছরের জুলাই-আগস্টের ওই গণ-অভ্যুত্থানের পর এবারই প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপিত হতে যাচ্ছে।
এবারের ঈদ নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, আনসার, কোস্ট গার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ছুটিতে যাচ্ছেন না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা যেন সুসংহত থাকে, সেই লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।
পবিত্র ঈদুল ফিতর আগামীকাল সোমবার, নাকি পরদিন মঙ্গলবার, তা জানা যাবে আজ সন্ধ্যায়। আজ রবিবার দেশের আকাশে ১৪৪৬ হিজরি সনের শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে কাল উদযাপিত হবে আনন্দের ঈদ, মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। আর আজ চাঁদ দেখা না গেলে সোমবার পবিত্র রমজান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হবে। সে ক্ষেত্রে ঈদ উদযাপিত হবে মঙ্গলবার।
পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা ও ঈদুল ফিতরের তারিখ নির্ধারণে আজ রবিবার জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে (বাদ মাগরিব) জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। গতকাল শনিবার ইসলামিক ফাউন্ডেশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। রবিবার দেশের আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্ধারিত টেলিফোন বা ফ্যাক্স নম্বরে তথ্য জানানোর অনুরোধ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
টেলিফোন নম্বরগুলো হচ্ছে ০২-২২৩৩৮১৭২৫, ০২-৪১০৫০৯১২, ০২-৪১০৫০৯১৬ অথবা ০২-৪১০৫০৯১৭। ফ্যাক্স নম্বর ০২-২২৩৩৮৩৩৯৭ বা ০২-৯৫৫৫৯৫১। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও অবহিত করা যাবে।
এদিকে সৌদি আরবে গতকাল পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ফলে দেশটিতে আজ ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের এসংক্রান্ত কমিটির বরাতে বাংলাদেশ সময় গত রাত ৯টা ১৪ মিনিটে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে মক্কা ও মদিনার নিয়মিত আপডেট দেওয়া ইনসাইড দ্য হারামাইন ফেসবুক পেজ।
সারা দেশে ছুটির আমেজ, রাজধানী প্রায় ফাঁকা : রাজধানীসহ সারা দেশে বিরাজ করছে ছুটির আমেজ। এই আমেজ চলবে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এবারের রোজার ঈদে সরকারি ছুটি মোট ৯ দিন। এর সঙ্গে যুক্ত হবে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার। সব মিলিয়ে ১১ দিন। গত বুধবার স্বাধীনতা দিবস থেকেই শুরু হয়েছে এই আমেজ। বৃহস্পতিবার সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত খোলা থাকলেও কর্মচাঞ্চল্য ছিল না। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে কয়েক দিন আগে থেকেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে রাজধানীবাসী। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ছিল ঘরমুখো মানুষের ভিড়। শনিবার পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যেই রাজধানী ছেড়েছে যাত্রীরা। গতকাল প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে রাজধানী।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঈদের পরের আন্ত নগর ট্রেনের ৩ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ২৪ মার্চ; ৪ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ২৫ মার্চ; ৫ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ২৬ মার্চ এবং ৬ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ২৭ মার্চ, ৮ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ২৯ মার্চ। এ ছাড়া ৯ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি করা হবে আজ ৩০ মার্চ।
জানা গেছে, এ বছরের রোজার ঈদ বছরের প্রথম দিকে হওয়ায় রাজধানীতে বসবাসকারী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার চাপ তেমন নেই। বই পেতে দেরি হওয়ায় অনেক জায়গায় ঠিকমতো ক্লাসও চলছে না। এই সুযোগে অনেক অভিভাবক তাঁদের পরিবারের সদস্যদের আগেভাগেই ঢাকার বাইরে নিজ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে গত বুধবার। তিন দিনের সরকারি ছুটিসহ এবার তাঁদের ছুটি ১০ দিন পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ২৬ মার্চ থেকে ১৬১টি কারখানায় ছুটি শুরু হয়েছে। ২৭ মার্চ থেকে ৩৭৪টি, ২৮ মার্চ থেকে ৬৪৮টি এবং গতকাল ৯২৪টি কারখানা ছুটি দিয়েছে। প্রায় শতভাগ কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ হয়েছে বলে বিজিএমইএর দাবি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিজিএমইএ সদস্য কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ১০৭, এর মধ্যে দুই হাজার ৯৮টি কারখানা বোনাস পরিশোধ করেছে, যা প্রায় ৯৯.৫৭ শতাংশ। এ ছাড়া মার্চের বেতন (১৫-৩০ দিনের) পরিশোধ করেছে এমন কারখানা দুই হাজার ৭৯টি, যা ৯৮ শংতাশের বেশি।
শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঈদের বোনাস, মার্চ মাসের বেতন বিজিএমইএসহ অন্যান্য সংগঠনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রায় সবাই পরিশোধ করেছে।
তবে টিএনজেডসহ সাতটি কারখানা বোনাসসহ বেতন পরিশোধ করতে পারেনি। বিজিএমইএ, শ্রম মন্ত্রণালয় ও শিল্পাঞ্চল পুলিশ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, বোনাস পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গতকালও আলোচনা চালাচ্ছিল।
ঈদের চাঁদ দেখার নিশ্চিত খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে বাজতে থাকবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। ১৯৩১ সাল থেকে বাজতে বাজতে গানটি ঈদুল ফিতরের অপরিহার্য আগমনী সংগীতে পরিণত হয়েছে।
রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন জামাতে নামাজ আদায়, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং সাধ্যমতো ভালোমন্দ খেয়ে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা। ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে এবং সুগন্ধি মেখে সবাই ঈদগাহে বা মসজিদে যায়। সেখানে সব শ্রেণির মানুষ এককাতারে ঈদের নামাজ আদায় করে। নামাজের পর চলে কোলাকুলি, যা ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। ঈদগাহ থেকে ফিরে চলে পরিবার, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে খাওয়াদাওয়ার পালা। চলে স্বজন, বন্ধুদের বাড়ি বা বিনোদনস্থানে বেড়াতে যাওয়া। এভাবে একই সঙ্গে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও সামাজিক আনন্দ উপভোগের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় ঈদের দিনটি।
ঈদুল ফিতরের আমেজ শুরু হয় আসলে রমজানের শুরু থেকেই। এবার গ্রীষ্মের দুঃসহ দাবদাহের মধ্যে সাধ্যমতো ঈদের কেনাকাটা সেরেছে সবাই। প্রিয়জনদের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করতে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে থাকা কয়েক কোটি মানুষ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে গেছে। কেউ কেউ এখনো পথে বা ঘর ছাড়ার প্রস্তুতির মধ্যে।
বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই : এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর গরমের অস্বস্তির মধ্যে কাটতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাপপ্রবাহ থাকতে পারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক ঈদের দিনের (৩১ মার্চ বা ১ এপ্রিল ধরে) আবহাওয়া সম্পর্কে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবহাওয়া মূলত শুষ্ক থাকবে, বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা তেমন নেই। গরমের অস্বস্তি থাকবে। সেই সঙ্গে মৃদু (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি) থেকে মাঝারি (৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি) তাপপ্রবাহ থাকতে পারে কোনো কোনো অঞ্চলে।’
নাজমুল হক আরো জানান, রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের বেশির ভাগ অঞ্চলে তাপপ্রবাহ থাকার আশঙ্কা বেশি। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ওপর দিয়েও কমবেশি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ছুটি নেই : সরকারের বিভিন্ন জনমুখী উদ্যোগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে জনগণ এবার স্বস্তিতে ঈদ যাত্রা করতে পারছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সকালে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এই মন্তব্য করেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে জনগণ নির্বিঘ্নে ও ভালোভাবে ঈদ যাত্রা করতে পারে এবং ঈদ শেষে নিরাপদে ঢাকায় ফিরে আসতে পারে।’
রাজধানীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘সবাই ছুটি ভোগ করছে। কিন্তু পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, আনসার, কোস্ট গার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ছুটিতে যাচ্ছেন না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা যেন সুসংহত থাকে, সেই লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
ঈদ বাজারে কিছুটা মন্দা : এবার ঈদ উৎসব ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ক্রেতা উপস্থিতি ভালো থাকলেও ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা চলছে। শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে শতাধিক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে লাখো কর্মী কাজ হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো ঠিকমতো বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে পারেনি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঈদের কেনাকাটায়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমানের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কিছুটা কমেছে। এ কারণে খরচ কমানোর প্রবণতা আছে মানুষের মধ্যে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার প্রভাবও আছে ঈদ বাজারে। কয়েক দিন আগে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদ কোনাকাটার ৮০ শতাংশই পোশাককেন্দ্রিক। সাধারণত প্রতিবছর বিক্রি কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাড়ে। কিন্তু গত বছরের ২০ রমজানের তুলনায় এবার একই সময়ের তুলনামূলক হিসাবে দেখা যায়, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পিছিয়ে আছে। আরো কয়েক দিনে বিক্রি কতটা বাড়বে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।