বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল, সেটিই প্রকারান্তরে ওই অভ্যুত্থানের তরুণ নেতাদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য হিসেবে উঠে এসেছে বলে অনেকের ধারণা। গত শুক্রবার এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলটির আহবায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের খসড়া ঘোষণাপত্রেও বলা হয়েছিল, ‘আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণসমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। আমরা এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।
” এই অবস্থায় এখানে অনেকের প্রশ্ন, এনসিপি কিভাবে তাদের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য পূরণ করবে? এ ছাড়া ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বিষয়টি জনপরিসরে এখনো স্পষ্ট নয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিষয়ে নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজছে।
এ ছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ওই খসড়া ঘোষণাপত্রে আরো বলা হয়, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।
ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এটি প্রকাশ করতে চেয়েছিল। সে সময়ও এর প্রয়োজন কী এবং এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং প্রথমে এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে জানায়।
অবশ্য পরে গত ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। ১৬ জানুয়ারি এ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বৈঠক হয়।
ঘোষণাপত্র নিয়ে সেদিনের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। সবাই বলেছেন এ ধরনের একটি ঘোষণাপত্র করার প্রয়োজন আছে।
তবে মোটাদাগে ঘোষণাপত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক ও আইনগত ভিত্তি কী হবে, সেটিও স্পষ্ট করতে হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি, ছাত্র-জনতাসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করতে হবে। এর জন্য যত সময় প্রয়োজন, নেওয়া যেতে পারে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ওই দিন বলেন, ‘আমরা প্রশ্ন করেছি, সাড়ে পাঁচ মাস পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন আছে কি না? যদি থাকে, সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আইনি গুরুত্ব কী; সেটা নির্ধারণ করতে হবে।’
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও সেদিন বলেন, ‘মোটাদাগে বলতে পারি, একটি ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন, সেটি প্রতিটি দল অনুভব করেছে, তবে তাড়াহুড়া করে নয়। তাড়াহুড়া করলে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এ জন্য সময় নিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে।’
এ ক্ষেত্রে ওই ঘোষণাপত্রের মতোই এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণ কিভাবে এবং কত দিনে সম্ভব বা আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এনসিপি যা বলছে : এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক সারোয়ার তুষার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার মানে হচ্ছে আমরা গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে চাই। এ লক্ষ্যে আমরা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ এবং দলকে সেদিকে সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করব। আর আমরা যদি সামনের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাই, তাহলে আমরা ওই সংসদকে গণপরিষদ ঘোষণা করব।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এ দাবিতে জণগণের মতামত অর্জন করার চেষ্টা করব। আমরা মনে করি, আগামী নির্বাচনটি গণপরিষদ নির্বাচন হওয়া দরকার। কারণ সংবিধান প্রণয়ন কিংবা সংস্কার করতে হবে। সংবিধান প্রণয়ন আর সংস্কার তো সংসদে করা যায় না। তাই গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন।’
একাধিক রিপাবলিকের উদাহরণ : বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে একাধিক রিপাবলিকের উদাহরণ রয়েছে ফ্রান্সে। ঘানা, উগান্ডা, মাদাগাস্কার, নাইজার, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপ, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, কোস্টারিকাসহ আরো কয়েকটি দেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা বদলের এই রাজনৈতিক ধারণাটি। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানসহ নানাভাবেই আসতে পারে এমন পরিবর্তন। ফ্রান্স একসময় রাজতন্ত্রের অধীন ছিল। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। ওই বিপ্লব চলার মধ্যেই ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে প্রথম রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। ১৮০৪ সাল পর্যন্ত প্রথম রিপাবলিক টিকে ছিল। এরপর আবার রাজতন্ত্র শুরু হয়। এ পর্ব চলে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ফ্রান্সে দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এটি টিকে ছিল ১৮৫২ সাল পর্যন্ত। দফায় দফায় শাসনব্যবস্থা বদলে ফ্রান্সে এখন চলছে পঞ্চম রিপাবলিক; যেটি ১৯৫৮ সালের ৪ অক্টোবর ঘোষণা হয়েছিল।
বিএনপির প্রশ্ন : এনসিপির ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ছাড়াও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তনে এক আলোচনাসভায় তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম লক্ষ্য সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন। আমি সমালোচনা করতে চাই না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব কর্মপন্থা থাকবে, আদর্শ থাকবে, গঠনতন্ত্র এবং ঘোষণাপত্রে এ রকম ঘোষণা থাকে। কেউ সমাজতন্ত্র চায়, কেউ অন্য কিছু চায়, কেউ হয়তো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমি নতুন বন্ধুদের বলতে চাই, সেকেন্ড রিপাবলিক কেন? আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘গণপরিষদ কেন হবে? এর মধ্যে তো আরো একটি উদ্দেশ্য আছে? যাঁরা গণপরিষদের বিষয় সামনে আনছেন, যাঁরা সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয় সামনে আনছেন, হয় তাঁরা বোঝেন না অথবা বুঝেই আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরো দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রের মধ্যে যাচ্ছেন। আপনারা গণপরিষদ কেন বললেন বুঝলাম না। গণপরিষদ তখনই হয়, যখন দেশে কোনো সংবিধান থাকে না। যখন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যে সংবিধানের ভিত্তিতে পরে পার্লামেন্ট ইলেকশন হয়। আমাদের এখানে গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য আমরা কি নতুনভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি? রাষ্ট্র তো স্বাধীন আছে। আমাদের বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।’
জামায়াত যা বলছে : জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী দল পরিচালনার অধিকার রাখে। তবে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে তারা কী বোঝাতে চেয়েছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চান, তা এখনো স্পষ্ট নয়।’
তিনি বলেন, “এই দলটি মূলত দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। প্রথমত, তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’—এমন একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দ্বিতীয়ত, তারা কোনো ধরনের দুর্নীতিকে বরদাশত করবে না। কেননা দুর্নীতিই পুরো বাংলাদেশকে বিভিন্ন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমি মনে করি, যদি তারা সত্যিই ভালো কাজ করে, তবে অবশ্যই এই দলটিকে স্বাগত জানানো উচিত।”
বাম দলগুলোর প্রতিক্রিয়া : বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ (মার্ক্সবাদী) নেতা মাসুদ রানা বলেন, ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র বা সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে নতুন দলের নেতারা কী বোঝাতে চাচ্ছেন, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম। স্বাধীন দেশে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছি। এখন নতুন সংবিধানের কী আছে? আর এই সরকার তো বিদ্যমান সংবিধানের অধীনেই শপথ নিয়েছে। সেই সংবিধানের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো সংশোধনের দাবি আমাদেরও। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে হতে হবে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা আকবর খান বলেন, ‘কোনো দল ঘোষণা দিলে বা দাবি জানালেই দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র হবে না। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যেকোনো সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। দ্রুতই প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। সেখানেই ঠিক হবে, দেশ কোন দিকে যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকারের দায়িত্ব প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। এর বাইরে কিছু করতে চাইলে দেশ অস্থিতিশীল হবে।’