
সন্দ্বীপের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে প্রায় এক দশক আগে জেগে ওঠা নতুন চর ঠ্যাংগা। দ্বীপ অবস্থানগত দিক থেকে সন্দ্বীপের কাছাকাছি হলেও সরকারিভাবে এটাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার সঙ্গে দেখানো হয়েছে। এতে ফুঁসে উঠেছে সন্দ্বীপ। তাদের তাদের দাবী ঠ্যাংগার চর হাতিয়ার নয়, সন্দ্বীপ।
এক মাস আগেও ঠ্যাংগার চর ছিল জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। নদীর কূল ও সাগরে থাকা জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপণ নেয়াসহ চরের পাশ দিয়ে যাতায়াতকারী মালবাহী লাইটার জাহাজগুলো থেকে চাঁদা আদায়ের অপরাধের স্থান এটি।
সম্প্রতি কক্সবাজারে অবস্থানরত মিয়ানমার নাগরিকদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের সরকারি পরিকল্পনার কথা জানাজানির পর চরটি রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠে। তবে সেটি এখনও বাসযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। কিন্তু সাগরের মুখে জেগে ওঠা নতুন এ চরটি রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের কতটুকু উপযুক্ত এ বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব-নিকেশের পাশাপাশি সরকারিভাবে এটিকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ঘোষণার প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে সন্দ্বীপবাসী। এক সপ্তাহ ধরে দ্বীপ এলাকা ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম এমন কি বিদেশেও সন্দ্বীপবাসীরা ঠ্যাংগার চরসহ পার্শ্ববর্তী চরসমূহ তাদের দাবি করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপ থেকে ২৫ কিমি পূর্বে এবং সন্দ্বীপ উপজেলার পশ্চিম উপকূল থেকে পাঁচ কিমি পশ্চিমে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ঠ্যাংগার চরের অবস্থান। চরে গুল্মলতা জাতীয় বিভিন্ন গাছপালা জন্মে তা শুকিয়ে ঢেউয়ের চোটে সন্দ্বীপ উপকূলে ভেসে আসত। নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় জেলেরা এসব শুকনো লতা জ্বালানির জন্য সংগ্রহ করত। এ চর থেকে ভেসে আসা এ সকল লতার (সন্দ্বীপী ভাষায় ঠ্যাংগা) নামেই জেলেরা এটিকে ‘ঠ্যাংগার চর’ বলতে বলতে এ নামেই এটি পরিচিতি হয়ে ওঠে। ঠ্যাংগার চরের দৈর্ঘ্য আট কিমি ও প্রস্থ সাড়ে চার কিমি। আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর। সন্দ্বীপ বন বিভাগের রোপণ করা কেওড়া গাছগুলো দিয়ে আচ্ছাদিত চরের প্রায় অংশ। চলাচলের জন্য এখানে কোন নির্দিষ্ট রাস্তা বা পথ নেই। বেশির ভাগ সময় পুরো চরটি কর্দমাক্ত থাকে। চরের ভিতরে রয়েছে কয়েকটি শাখা খাল। নিচু হওয়ায় ভরা কাটালের জোয়ারের সময় চরটি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। এটি এখনও বসবাসের উপযোগী হয়নি বিধায় এখানে কোন সাধারণ মানুষ বসবাস করে না। তবে মহিষ পালনের জন্য কয়েকজন বাতাইন্যা (রাখাল) উঁচু মাচায় বসবাস করে। নানা প্রতিকূলতার কারণে এখনও সেখানে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী কোনো মানববসতি গড়ে ওঠেনি বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ঠ্যাংগার চরকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালে। ইঞ্জিনচালিত নৌযান ছাড়া সেখানে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। হাতিয়া থেকে যেতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। শীতের সময় শুকনো থাকলেও বর্ষার সময়ে চরটির বেশির ভাগ অংশ পানিতে ডুবে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে বোট, কিংবা গাছের উপর বিশেষ কায়দায় অবস্থান করে সন্ত্রাসী ও জলদস্যু গ্রুপ এখানে চাঁদা আদায়সহ সাগরে বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। কাঠের তৈরি দোতলা একটি ঘরের মাধ্যমে জলদস্যুরা সাগরের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে।
সন্দ্বীপ উপজেলা সারিকাইতের জেলে পরিমল জানান, গত বছর ইলিশ মৌসুমে মাছ ধরার ট্রলার ও আমাদের আরো চার জন সহকর্মীকে জলদস্যুরা ঠেংগার চরে নিয়ে যাওয়ার দু’দিন পরে মুক্তিপণ হিসেবে এক লাখ টাকা দেয়ার পর ছেড়ে দেয়। তিনি জানান, নদী শান্ত থাকলে জলদস্যুরা জেলেদের অপহরণের উদ্দেশ্যে ট্রলারসহ এখানে আস্তানা ঘাড়ে। জেলেদের ও মালবাহী জাহাজের কাছ থেকে আদায় করে মুক্তিপণ। দ্বীপটির অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক থাকায় কোস্টগার্ড কিংবা পুলিশ জলদস্যুদের বার বার তাড়া দিয়েও এ পর্যন্ত তেমন কোন ফলাফল অর্জন করতে পারেনি।

স্থানীয় সমাজকর্মী ও সাংবাদিক সালেহ নোমানের মতে, জেগে উঠা চরটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। তাই এখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। চরটির একক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে হাতিয়া ও সন্দ্বীপের বেশ কিছু সন্ত্রাসী ও জলদস্যু প্রাণ হারিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে হাতিয়া ও নোয়াখালীকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী ও জলদস্যুরা এই চরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে চাঁদাবাজি ও অপকর্ম চালাত। তবে গত দু’তিন দিন আগে নৌবাহিনীর একটি কনটিনজেন্ট এখানে আসার পর জলদস্যুরা পালিয়ে গেছে বলে স্থানীয় জেলেরা জানান।
জানা গেছে, গত বুধবার নৌবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ চর পরিদর্শনে যান। চরে হেলিপ্যাড ও পল্টুন স্থাপনের কাজ চলছে। রোহিঙ্গা স্থানান্তরে দ্বীপটিকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার সরকারী পরিকল্পনা এগিয়ে চললেও সংশিহ্মষ্ট উপজেলা হাতিয়া ও সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গা স্থানান্তর সংক্রান্ত কোন প্রকার দাপ্তরিক চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করা হয়নি।

কয়েকদিন ধরে ঠেংগার চরে সরকার, ইউএনএইচসিআর, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার কর্মকর্তাদের ঘুরে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সপ্তাহখানেক আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাংবাদিকরা এ চর ঘুরে এসে রোহিঙ্গাদের এখানে পাঠানোর উদ্যোগকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যায়িত করে তাতে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয় বলে সমালোচনা করেছেন। এছাড়া রোহিঙ্গারা অপরাধপ্রবণ ও বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় তাদের স্থানান্তর নিয়ে ঠেংগার চরের কাছাকাছি সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু তার চেয়ে এখানকার মানুষ বেশি বিক্ষুব্ধ এই কারণে যে, সরকারি ঘোষণায় জাহাজ্যার চর ও ঠ্যাংগার চরটিকে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা দেয়ায়। এ মুহূর্তে সরকারি পরিকল্পনা কি হচ্ছে তা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর চেয়ে নিজদের ভূমির স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে তারা অনড়। সাধারণ জনগণের দাবি এখানকার ভেঙ্গে যাওয়া সাবেক ইউনিয়ন নেয়ামস্তি ও ইজ্জতপুরের সীমানায় সাগর থেকে জেগে উঠেছে ঠেংগার চর।

এক সপ্তাহ ধরে সন্দ্বীপসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও প্রবাসে সন্দ্বীপবাসীরা তাদের ভেঙ্গে যাওয়া জেগে ওঠা পুরাতন ভূমিগুলোর এ দ্বীপকে (ঠ্যাংগা, জাহাজ্যা) পূর্ব পুরুষদের ভিটা আখ্যায়িত করে এটি সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে পুনরায় ঘোষণা দেয়ার দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন, সভাসমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। দলমত নির্বিশেষে স্লোগান তুলেছে দ্বীপবাসী- ‘বাপ দাদার ভিটা চর, সন্দ্বীপবাসী রক্ষা কর’।
সন্দ্বীপ উপজেলা আইন শৃংখলা কমিটির বিগত সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মাস্টার শাহজাহানের উপস্থিতিতে বক্তারা বলেন, সরকারি নির্দেশনা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে আন্তঃজেলা সীমানা নির্ধারণ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় একতরফাভাবে ঠ্যাংগার চর আজ হাতিয়ার উল্লেখ করা হচ্ছে যা সন্দ্বীপবাসীকে হতবাক ও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
জাতীয় সংসদের বর্তমান অধিবেশনে সন্দ্বীপ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, সন্দ্বীপের ভেঙ্গে যাওয়া বিভিন্ন ইউনিয়নের শত শত মানুষ এখানে ওখানে মাইগ্রেট হয়ে বসবাস করছে। আবার অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বেড়িবাঁধে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাগরে চর জেগে ওঠা দেখে তারা আশায় বুক বেঁধেছে পুরনো ভিটায় আবার নতুন করে বসবাস করার। আমার এলাকার নদী ভাঙ্গা মানুষগুলোকে যেখানে আশ্রয় দিতে হিমশিম খাচ্ছি সেখানে ঠেংগার চরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের বিষয় সন্দ্বীপবাসী মেনে নেবে না।
* ঠ্যাংগার চরে সাইনবোর্ড স্থাপন করে কর্তৃত্ব নিল সন্দ্বীপবাসী