
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় গত ছয় মাসে পানিতে ডুবে মারা গেছে ৩৮ শিশু কিশোর। এদের বয়স ৮ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছর। সর্বশেষ সাঁতার না জানায় সাগরে প্রাাণ হারান রাউজানের চুয়েটের মেধাবী ছাত্র নাকিব মোহাম্মদ খাব্বাব। তার এ মৃত্যু চোখ খুলে দিল প্রশাসনের।
তাই এবার নিজ বাংলো ফুলঝুড়ির পুকুরকে ‘সুইমিং পুল’ বানিয়ে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানো শুরু করেছেন রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম হোসেন।
খবর নিয়ে জানাগেছে রাউজানে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু ঘটনা। গত ৬ মাসে ৩৮ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে অভিভাবক ও স্থানীয় প্রশাসন। গত ৭ আগষ্ট সোমবার পুকুরে ডুবে আয়েশা ইসলাম (৩) নামের এক শিশুকন্যার মৃত্যু হয়। সে উপজেলার পূর্বগুজরা ইউনিয়নের আয়েশা বিবির বাড়ির আরব আমিরাত প্রবাসী সেকান্দর হায়াতের কন্যা। গত ৩ আগষ্ট পুকুরে ডুবে ফুয়াদ আনোয়ার সামি (১৩) নামে পঞ্চম শ্রেণীর (ইংলিশ মিডিয়াম) এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। সে রাউজান পৌর এলাকার ৭নং ওয়ার্ডের আদালত ভবণ এলাকার চৌধুরী বাড়ির সৌদি আরব প্রবাসী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর একমাত্র পুত্র। এর আগে ২২ জুলাই পুকুরে ডুবে আদিবা ইসলাম মাহি (২) নামে এক শিশু কন্যার মৃত্যু হয়। সে রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চৌধুরী হাট এলাকার আইয়ুব আলী সওদাগর বাড়ির আব্দুল মাজিদের মেয়ে।
গত ১৪ জুলাই মো. রাব্বি (৪) নামে এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সে উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি গ্রামের অছিমিয়া চেয়ারম্যান বাড়ির সাহাবুদ্দিনের একমাত্র পুত্র। গত ৫ জুন উম্মে হাবীবা (২) নামের এক শিশুকন্যা পুকুরে ডুবে মারা যায়। সে উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের ফকিরপাড়া এলাকার হাজী হামদু মুন্সি তালুকদার বাড়ির মো. রফিকের কন্যা। গত ৩০ জুন আরফাত হোসেন (২) নামের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সে উপজেলার পূর্বগুজরা ইউনিয়নের ইসলামাবাদ গ্রামের হাজি আজিজুর রহমান বাড়ির ওমান প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের একমাত্র পুত্র। গত ৯ মে মোহাম্মদ জোনায়েদ (৩) নামে এক শিশু পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয়। সে উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের গুচ্ছ গ্রামের মুহাম্মদ মহসিনের পুত্র। গত ২৩ মে শহীদুল আলম (১০) নামে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রের মৃত্যু হয়। সে উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের কচুখাইন মধ্যপাড়া গ্রামের ফরিদুল আলমের পুত্র। গত ১০ মার্চ রাউজানে পুকুরের পানিতে ডুবে পুতুল (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়।

রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের উত্তর ঢাকাখালী গ্রামে মামার বাড়ীতে মা’র সাথে বিয়ের দাওয়াতে এসে এক শিশু পানিতে ডুবে শিশুটি মারা যায়। সে হাটহাজারী উপজেলার মধ্যম মাদার্শা বড়ুয়াপাড়ার জনৈক মানিক বড়ুয়ার কন্যা। গত ৪ মার্চ শনিবার পুকুরে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলো গোদারপাড় এলাকার অর্জুন সওদাগর বাড়ির প্রবাসী অরুন বড়ুয়ার ছেলে দেবরাজ (৮) ও প্রবাসী সুমন বড়ুয়ার ছেলে যুবরাজ (৫)। নিহত দুই শিশু পরস্পর চাচাতো জেঠাতো ভাই।
এর আগেগত ২২ ফেব্রুয়ারি নিহা আকতার (২) নামের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। নিহত শিশু রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের বদু পাড়া সৈয়দ বাড়ির দুবাই প্রবাসী মোহাম্মদ হোসেনের কন্যা।
ইউএনও মো. শামীম হোসেন বলেন, রাউজানে ছয় মাসে ৩৮ শিশু মারা গেছে পানিতে পড়ে। তারা যদি সাঁতার জানত তবে প্রাণে বেঁচে যেত। রাউজানে তো সুইমিং পুল নেই যে বাচ্চারা সাঁতার শিখবে। একটি সুইমিং পুল বানাতেও ছয় মাস সময় লাগবে। এত দিন বাচ্চারা মারা যাবে পানিতে ডুবে আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব তা তো হয় না। তাই নিজের বাংলোর পুকুরেই সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নিলাম।
রাউজান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন এবং উপজেলা স্কাউটসের সহযোগিতায় শুরু করেছেন ‘সাঁতার শিখুন জীবন বাঁচান’ শীর্ষক সাঁতার শেখানো কর্মসূচি। শুক্রবার প্রথম দিন এবং আজ শনিবার ১৬ জন সাঁতার শেখানো হয়।

তাদেরই একজন মাসরুর তাহাসিন। মোহাম্মদপুর গ্রামের এ শিশুটির অভিভাবক মুহাম্মদ রুস্তমগীর বললেন, রাউজানে পুকুরে পড়ে, পানিতে ডুবে এত বেশি শিশু মারা যাচ্ছে অভিভাবকরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন। কিন্তু সাঁতার শেখানোর মতো ফুরসত নেই কারও। সর্বশেষ চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র নাকিব মোহাম্মদ খাব্বাব যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল নদীমাতৃক এ দেশে সাঁতার না জানাটা বড় পাপ।
এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে বাংলোর পুকুরে সাঁতার শেখানোর আয়োজন করছেন শুনে ছেলেকে নিয়ে আসি। অনেক যত্ন করে তিনি সাঁতার শিখিয়েছেন। ক্লান্ত শিশুদের নাশতা করিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বাচ্চাদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিযোগিতার আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি জানান, প্রতি শুক্র ও শনিবার সকাল আটটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েদের সাঁতার শেখানো হবে বলে জানানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম হোসেন রেজা আরো শিশু মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘পারিবারিক অসচেতনতা ও সাতার না জানার কারণে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার পর আমি প্রতি শুক্রবার ও শনিবার শিশুদের সাতার শেখানোর জন্য উপজেলা সরকারী বাসভনস্থ একটি পুকুর উন্মোক্ত ঘোষণা করেছি। শিশু সন্তানদের চোখে চোখে রাখার পরামার্শ দিয়ে তিনি বলেন পরিবারের সদস্যরা সচেতন হলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা সম্ভব।’
ইউএনও বলেন, আমরা পুকুর ও আশপাশের এলাকাটি সিসিটিভির আওতায় রেখেছি নিরাপত্তার জন্য। এ ছাড়া স্কাউট ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনতো থাকছেই। সুতরাং অভিভাবকরাও নিশ্চিন্তে বাচ্চাদের সাঁতার শেখানোর জন্য আনছেন। আমরা চাই অভিভাবকদের সচেতন করতে। একটু সময় দিলেই বাচ্চারা সাঁতার শিখে ফেলতে পারে। এর জন্য সুইমিং পুল প্রয়োজন নেই। আমরা মা-বাবার ভয় তাড়াতে চাই। আশাকরি, সফল হবো।
এ ব্যপারে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ এদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডোবা। এর জন্য সামাজিক আন্দোলন দরকার। তবে অর্ধেক সাঁতার শেখালে হবে না। মোটামুটি দক্ষ করে তুলতে হবে।