ফন্ট সাইজ

শেয়ার করুন

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print

“রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”

সংবাদটি পড়তে সময় লাগবে মিনিট

অধ্যক্ষ ডা. বরুণ কুমার আচার্য্য (বলাই)

maxresdefault
ঈদ উৎসব….

মানবপ্রেমিক, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পবিত্র মাহে রমজান নিয়ে অনেক গান গজল কবিতা রচনা করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের সেই সমস্ত রচনা গুলো রমজান মোবারক যখন মানুষের সামনে আসে তখন এই রচনা গুলো প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন মানুষ আগ্রহ সহকারে শুনতে থাকে। চর্চা হয় নজরুল গবেষণা ও নজরুল রচনা সমূহে। পবিত্র মাহে রমজানকে সামনে রেখে আমার এই প্রবন্ধের মাধ্যমে মানবতাবাদী ও মানুষ নজরুল এর চেতনাকে তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস মাত্র। নজরুলের কবিতার মাধ্যমে বাঙালী সমাজ মহাপবিত্র রমজানকে বিদায় জানান, এভাবে-
“রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”
উপমহাদেশীয় দর্শনে অহিংসা, অচৌর্য, সংযম, শৌচ এবং সত্য এই পাঁচটি মানবিক গুণকেই মানবিকতা বা মনুষ্যত্ব বলা হয়। যার জন্য মানুষ সুন্দরকে বরণ করে, কুৎসিতকে বর্জন করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, ভীত হয় না সত্যকে স্বীকার করতে। বিপদের দিনে একজন মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য সহযোগিতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, কুণ্ঠিত হয় না। মানুষ হিসেবে মানুষকে ভালবাসতে, ভালোবাসে যা কিছু ভালো আছে এই সমাজে। মানবতাবাদী চিন্তা চেতনার অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাণী ও কবিতার প্রতি আমি ছোট্ট কাল থেকেই অনুরাগী ছিলাম। যখন থেকেই বড় হচ্ছি প্রতিদিনই কাজী নজরুল ইসলামের সেই চেতনার সাথে বারেবারে আমি মন ও মননে একত্রিত হয়ে যাচ্ছি।
২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমার সেই প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভূমির স্মৃতি বিজড়িত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আসানসোল-এর চুরুলিয়া গ্রামে দুখু মিয়ার সেই বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়। চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক সোহেল মো. ফখরুদ-দীনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে ভারত গমন করি। বিখ্যাত কবি সংগঠক ও নজরুল গবেষক সাংবাদিক রাজীব ঘাঁটি ও সাংবাদিক নারায়ণ মজুমদার (বর্ধমান প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক) আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবি ভিটেতে আমাদের সম্মান প্রদর্শন করা হয় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের। বাংলাদেশ থেকে আরো যারা ঐ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন তাদের মধ্যে ড. অধ্যক্ষ রেজাউল কবির, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মুফিজুর রহমান, কবি আসিফ ইকবাল প্রমুখ। আমরা সেদিন কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাল্যকালের স্মৃতির সকল স্থাপনা, মসজিদ, মক্তব, আসানসোলের রুটির দোকান, আসানসোলের স্টেশন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখি। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। কবির ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভারত কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমির প্রাক্তন সম্পাদক কবি কাজী রেজাউল করিম আমাদেরকে কবি বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ ও সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রতি আবারও কৃতজ্ঞতা। কাজী নজরুল ইসলামের মানবচেতা ও মানবতাবাদী কবিতাগুচ্ছ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে “মানবপ্রেমিক, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক কবি কাজী নজরুই ইসলাম” আমার আজকের এই প্রবন্ধ। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মনুষ্যত্ব ধর্মে দীক্ষিত এমনই একজন মানবদরদী মরমী কবি। তাইতো তিনি বলেছেনÑ
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
সত্যের পূজারী নজরুল, সমাজে যাদের মুখ ও মুখোশ ভিন্ন তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে অসত্যের আশ্রয়ে তারা নিজেকে নিজেই ঠকাচ্ছে এবং বিশ্বের কাছে হাস্যকর ও ছোট প্রতিপন্ন হচ্ছে। তাই তিনি ‘বিদ্রোহীর বাণী’ কবিতায় বলেছেনÑ
“সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরাই আবার করবি কাজ,
ফোঁপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ।
দোহাই তোদের এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল।
ঢের দেখালি ঢাক ঢাক আর গুড় গুড় ঢের মিথ্যা ছল।
এবার তোরা সত্য বল।”
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের অধিকাংশ সময়ই তাঁকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এরই ফলে তিনি ভারতীয় দারিদ্র্য সমাজকে চিনতে ও বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেনÑ
“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছো মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান।”
সমাজের নিুশ্রেণীর মানুষ যারা দিন এনে দিন খায়, যাদের অধেক দিন খাবার জোটে না, যারা তাদের পরিবারের জন্য খালি পেটে গাধার খাটুনি খাটেÑকিন্তু পায় দু-চার পয়সা। তাদের জন্যও কবির প্রাণ কাঁদে। তা দেখা যায় তাঁর একটি গানে।
“সারাদিন পিটি কা’র দালানের ছাদ গো,
পেট ভরে ভাত পাইনা, ধরে আসে হাত গো।
তোর ঘরে আজ কি রান্না হয়েছে,
ছেলে দুটো ভাত পায়নি পথ চেয়ে রয়েছে।”
এছাড়া কবি তার ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় তাঁর প্রতিবাদী সুরে বলেছেনÑ
“ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন
বেলা বয়ে যায়, খায়নি’ক বাছা কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
প্রার্থনা করোÑযারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।”
এই মানব জাতির কল্যাণেই কবি হৃদয় সদা সর্বদা ব্যাকুল হয়েছে। প্রয়োজন থেকে তাহা কখনো হয়েছে কঠোর, কখনও বা হয়েছে কোমল। অন্যায়ের প্রতিবাদে কখনও তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী, আবার সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে, কল্যাণ কামনায় কখনও তিনি হয়েছেন মরমী ও দরদি কবি। সমাজে যারা নির্যাতিত, অবহেলিত, ঘৃণিত, তাদের কথা তিনি বিভিন্ন কবিতা ও গানে ব্যক্ত করেছেন, তাঁর প্রতিবাদী ভাষায়। অপমানিত নিুবর্ণের মানুষের প্রতি উচ্চবর্ণের সীমাহীন ঘৃণারও তিনি প্রতিবাদ করেছেন। সমাজের প্রতি কটাক্ষ করে তিনি তাঁর ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় লিখেছেনÑ
“জনগণে যারা জোঁক সম শোষে, তারে মহাজন কয়
সন্তানসম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ, মাটির মালিক তাহারাই হন।
যে যত ভণ্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।”
তাই তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে বলেছেনÑ
“এই ধরনীর ধুলি মাখা তব অসহায় সন্তান,
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি পিতা ভগবান।”
তখনকার নির্যাতিত নারী সমাজ এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যে একে অপরের পরিপূরক এবং নারী ছাড়া পুরুষের কোন অস্তিত্ব নেই, তা তিনি তাঁর ‘নারী’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনÑ
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্র“বারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারি।
এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ রস মধু গন্ধ সুনির্মল।
কোন কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি।
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছেÑবিজয়লক্ষ্মী নারী।”
সমাজে অবহেলিত, ঘৃণিত বারাঙ্গনাদের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন যে, তাহারাও আমাদেরই মত একই রকম। সতী না হলেও তাহারা আমাদেরই মাতা, ভগিনীরই জাতি। তাহাদের ছেলেরা আমাদের জ্ঞাতি। আমাদেরই বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-বাবা-কাকাই তাহাদের পিতা। সুতরাং সমাজে পতিতা বা ঘৃণিতা বলে বিবেচিত হবে কেন? তাই তিনি বলেছেনÑ
“শুন ধর্মের চাঁইÑ
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোন সে প্রভেদ নাই।
অসতী মাতার পুত্র যে যদি জারজ পুত্র হয়।
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।”
কুলি, মজুর, মুটে যাহারা সব সময় অবহেলিত হয়, তথাকথিত সমাজের উচ্চ শ্রেণীর কাছে, যাহারা প্রতি পদক্ষেপে অপমানিত হয়, তাহাদের অবস্থার কথাও কবি ‘কুলিমজুর’ কবিতায় বলেছেন
“দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবুসা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে,
চোখে ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।”
কাজী নজরুল সমাজের এই উপেক্ষিত মনোভাবের প্রতিবাদে পরে এই কবিতায় বলেছেনÑ
“তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধুলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান।
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।”
সমাজ শুধু পাপী বা চোর ডাকাতের বিচার নিয়েই ভাবছে/মাতামাতি করছে। সমাজের রাঘব বোয়াল যারা সাধারণ মানুষকে নিঃশেষ করে নিজেদের সমাজে গণমান্য বলে প্রতিষ্ঠিত করছেÑসমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের কথা কেন সমাজ ভাবছে না, কেন প্রতিবাদ করছে না? তাই মরমী ও দরদি নজরুল ‘চোরডাকাত’ কবিতায় বলেছেনÑ
“ইহাদের মত অমানুষ নহ হতে পার তস্কর
মানুষ দেখিলে বাল্মীকি হও, তোমরা রতœাকর।”
একই সুরে তিনি ‘পাপ’ কবিতায় বলেছেনÑ
“এ পাপ মুলুকে পাপ করেনিকো, কে আছ পুরুষ নারী,
আমরা ত ছারÑপাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী।
সাম্যের গান গাইÑযত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।”
কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন দুঃখের সাগরে মন্থিত হলেও মানুষ ও মানব প্রেমকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বার বার প্রতিবাদের সুরেই মানব কল্যাণের দিকে ফিরে চেয়েছেন। তাই তিনি মানবাত্মার পূজারী, সত্যের পূজারী, হৃদয়ের পূজারী, মানবপ্রেমিক কাজী নজরুল ইসলাম।

লেখক: অধ্যক্ষ ডা. বরুণ কুমার আচার্য্য (বলাই)
সভাপতি চট্টগ্রাম সাহিত্য সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র

সর্বশেষ

ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে চট্টগ্রামে বিআরটিএ’র বিশেষ অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা হয়নি: প্রেস সচিব

সিরিয়ার ঋণ শোধ করবে সৌদি-কাতার

ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ

প্রথম চুয়েটের রিফাত আল ইব্রাহিম ⦿কেএসআরএম অ্যাওয়ার্ড পেলেন তিন ভবিষ্যৎ স্থপতি

ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আগ বাড়িয়ে মধ্যস্থতা করতে চায় না বাংলাদেশঃ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সন্ধ্যায় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে প্রথমবারের মতো উড়াল দেবে কার্গো ফ্লাইট

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print