
চট্টগ্রাম কক্সবাজার আরকান সড়কে দীর্ঘদিন ধরে সাদা মাইক্রোবাসবাহী একদল সশস্ত্র ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। বিকেল থেকে এ সড়কে শিকার খুঁজে বেড়ায় এ সাদা মাইক্রোবাসটি। বোয়ালখালী উপজেলার বেশ কয়েকজন এ ডাকাতদের কবলে পড়েছিল।
তখনই মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে মারধর, শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নামিয়ে দেয়া হত নির্জন স্থানে।
এ আতঙ্ক শুরু হয় গত ৩-৪ বছর ধরে। তবে কবলে পড়া লোকজন আইনশঙ্খলা বাহিনীর কাছে মৌখিক জানালেও প্রাণ ভয়ে এবং হয়রানির আশঙ্কায় মামলা দায়ের করেননি।
বিগত ঈদুল ফিতরের দুইদিন পর পটিয়া বাদামতল থেকে বোয়ালখালী পৌর সদরের মীরপাড়া এক যুবককে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এ ডাকাতদল। তিনদিন আটকে রেখে মুক্তি দেয় তাকে। এ ব্যাপারে র্যাব পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিল যুবকটি। বিষয়টি নাড়া দিয়েছিল পুলিশকে। বারবার আলোচনায় আসে সাদা মাইক্রোবাসবাহী সশস্ত্র ব্যক্তিরা কারা ? তথ্য প্রমাণের অভাবে যেন কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।
একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠে ডাকাতদল। আরকান সড়ক হয়ে ওঠে আতঙ্কপুরী। কর্মজীবি মানুষজন বিকেল গড়াতে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। স্বজনার ঘরের দরজায় অপেক্ষায় থাকে বাইরের মানুষটি সন্ধ্যার আগেই যেন বাড়ি ফিরেন।
ডাকাত কবলিতরা জানায়, এ চক্রটি আরকান সড়কে পটিয়া বাদামতল থেকে বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরা নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ এলাকায় কবলিত ব্যক্তিকে নামিয়ে দেয় বা তুলে নেয়। এছাড়া শিকারের জন্য অভ্যন্তরীণ সড়কও বেছে নিত।
এছাড়া একটি চক্র নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে পটিয়া বাদামতল পর্যন্ত সিএনজি টেক্সীতে যাত্রী বেশে একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে বোয়ালখালীবাসীকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছিল দীর্ঘদিন।
আসন্ন কোরবানীর ঈদকে ঘিরে এ চক্রটি সক্রিয় হয়ে শিকার খুঁজতে নামবে এ আশঙ্কায় পুলিশ এ সড়কসহ অভ্যন্তরীন সড়কগুলোতে নজরদারি বাড়ায়।
বোয়ালখালী থানা পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে হন্য হয়ে এ চক্রকে নাগালে আনতে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। অত্যন্ত চালাক এ চক্রটি। পুলিশের সাথে যেন ইঁদুর বেড়াল খেলা মেতেছে। কিছুতে নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না।
গত ৩ সেপ্টম্বর কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের মো. কালু সওদাগরের ছেলে বশিরুল আলম প্রবাস থেকে দেশে এসে বাড়ি ফেরার পথে এ চক্রের শিকারে পরিণত হন। সেদিন তিনি চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে রাত ১০টার দিকে চকরিয়ার নিজ বাড়ীর দিকে রওনা দেন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া মোজাফফরাবাদ নামক স্থানে রাত সাড়ে ১১ টার সময় সাদা রঙয়ের একটি মাইক্রোবাস পিছন থেকে এসে গতিরোধ করে ।
মাইক্রোবাসে থাকা সশস্ত্র ডাকাতদল বশিরুল ও তার চালককে গাড়িসহ অস্ত্রেরমুখে জিম্মি করে । রাত সাড়ে ১২টার দিকে বোয়ালখালীর শাকপুরা নুরুল হক ডিগ্রী কলেজের সামনে নিয়ে আসে।
অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মারধর করে নগদ টাকাসহ সাড়ে ৫লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুঠে নেয়। এসময় টহল পুলিশের দল ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে। ততক্ষণে পাশ কাটিয়ে কালুরঘাটের দিকে চলে যায় সাদা মাইক্রোবাসটি। পুলিশ দ্রুত কালুরঘাট ব্রীজে দিয়ে যাতে পার হতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয় পাশাপাশি অভ্যন্তরীন সড়কও পুলিশ ঘিরে ফেলে।
অবস্থা বেগতিক দেখে কৌশলে মাইক্রোবাসটি ঢুকে পড়ে পশ্চিম গোমদন্ডীর সড়কে। এরই মধ্যে রাত পেরিয়ে ৪ সেপ্টেম্বর সকাল। আত্মগোপনে চলে যায় সাদা মাইক্রোবাসটি। সব সড়কে পুলিশি নজরদারি। বোয়ালখালী থানা পুলিশের একাধিক টিম সাড়াঁশি অভিযানে নামে। পুলিশের হাতে আটকা পড়ে সাদা মাইক্রোবাসটি । তবে তাতে নাম্বার প্লেটযুক্ত এবং এক বয়স্ক মহিলা বসা।
পুলিশের কাছে সংবাদ ছিল মাইক্রোবাসটি নাম্বারপ্লেট বিহীন ,এতে ৫-৬ জন যুবক ও লুণ্ঠিত মালামাল রয়েছে। মেলাতে পারছিল না পুলিশ। নিশ্চিত হতে পারছিল না এটাই কি সে মাইক্রোবাস। জানতে চায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে, চালক জানায় তার মা খুব অসুস্থ ডাক্তারের কাছে নেয়া হচ্ছে। পুলিশের মন গলানোর চেষ্টায় চালক ও চালকের অসুস্থ মা আকুতি জানায়।
হাজার হোক পুলিশ বলে কথা। কথায় আছে চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। পুলিশ গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করে নেয়। এরপর নাছোড়বান্দা পুলিশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স রেখে দিয়ে থানায় এসে কাগজ পত্র নিয়ে যেতে বলে ছেড়ে দেয়। একে তো অসুস্থ মহিলা তার ওপর ছেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে তাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে চালককে নরজদারি করতে শুরু করে দেয় পুলিশ। দিন গড়িয়ে রাত চালককে কব্জায় নেয় পুলিশ। সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে জানতে পারে পশ্চিম গোমদন্ডীর কর্ণফুলীর তীরের ননইয়ার মা ঘাট দিয়ে নৌকা যোগে লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে পার হয়ে গেছে ডাকাতদল । মাইক্রোবাসটিতে নাম্বার যুক্ত করে ও ঘর থেকে নিজের মাকে নিয়ে পুলিশের চোখে ধোকা দিয়ে পালাতে চেয়েছিল চালক।
এরপর ডাকাতদের অবস্থান নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম জেলার উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একেএম এমরান ভূঁইয়া, সহকারী পুলিশ সুপার (পটিয়া সার্কেল) মো. জাহাঙ্গীর, বোয়ালখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সালাহ উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশের একাধিক টিম ৫ সেপ্টেম্বর দিনরাত ও ৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতভর চট্টগ্রাম নগর, কক্সবাজার জেলা ও বান্দরবান জেলায় অভিযান চালিয়ে ৫ দুর্ধর্ষ ডাকাতকে গ্রেফতার, ১টি আগ্নেয় অস্ত্র, ২টি গুলি, ভাগ হয়ে যাওয়া প্রবাসীর লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার ও ডাকাতিতে ব্যবহৃত সেই সাদা মাইক্রোবাস বান্দরবান জেলা থেকে জব্দ করেন।
অভিযানে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার নোয়াগাঁও গ্রামের ফিরোজ মিয়ার ছেলে ডাকাত নূর উদ্দিন (২৫), কক্সবাজার উখিয়া থানার হলুদীয়া গ্রামের আলী আহমদের ছেলে মো. হেলাল(২৯), সুনামগঞ্জের ছাতক থানার সিংসাপুর গ্রামের মো. ইউনুছের ছেলে মো. শুক্কুর (২২), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার পিঙ্গুলিয়া গ্রামের শেখ শাহাজাহান শাহীনের ছেলে শেখ কামরুল হাসান প্র: কাজল (২৩), চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ কাতালগঞ্জ এলাকার মো. আবদুল হাসেমের ছেলে মো. ছাদেক রেজা (২৩) কে গ্রেফতার করা হয়।
বোয়ালখালী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সালাহ উদ্দিন চৌধুরী এ ব্যাপারে জানান, ৭ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে ডাকাতদের লুণ্ঠিত আরো মালামাল ও কিছু স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া লুণ্ঠিত স্বর্ণ ক্রেতাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গ্রেফতারকৃত ডাকাতদের জিজ্ঞাবাদের জন্য দশদিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।