
৭১র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী ও সাহিত্যিক এবং উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি বেগম মুশতারী শফীর রাষ্ট্রিয় মর্যদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আজ (২১ ডিসেম্বর) বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগরীর চৈতন্যগলিতে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে বাদ জোহর নগরীর জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ অসংখ্য মানুষ অংশ নেয়।

জানাজার পূর্বে বেলা সাড়ে ১১টায় শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীর মরদেহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আনা হলে সেখানে তাকে শেষবাবের মত এক নজর দেখতে এবং তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজারো মানুষের ঢল নামে। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধা গার্ড অব অনার দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)র একটি চৌকস দল।

এ সময় ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আবসার, নারীনেত্রী নূরজাহান খান, প্রফেসর রীতা দত্ত,নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, লেখিকা আনোয়ারা আলম, আইনজীবি ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, ডা. চন্দন দাশ, শীলা দাশগুপ্ত, কবি আশীষ সেন, রাশেদ হাসান।
এসময় বেগম মুশতারী শফীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন কবি আবুল মোমেন, চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার, অধ্যাপক বেণু কুমার চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, প্রমার সভাপতি রাশেদ হাসান।

এছাড়াও উদীচী, কমিউনিস্ট পার্টি, সনাক, বোধন, প্রমা, খেলাঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মহিলা কলেজ, বাসদ, জেলা শিল্পকলা, সিআরবি রক্ষা মঞ্চ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, নারী যোগাযোগ কেন্দ্র, ফুলকি, বিটা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, যুব ইউনিয়ন, বিজয় মেলা পরিষদ, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, অগ্নবীণা পাঠাগার, গণজাগরণ মঞ্চ, ব্লাস্ট, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বিপ্লবী তারেকশ্বর স্মৃতি পরিষদ শ্রদ্ধা জানায়।
উল্লেখ্য- গত ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেগম মুশতারী শফী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৮৩ বছর বয়সী বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। এছাড়া বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগও ছিল। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য স্বজন রেখে গেছেন। এর আগে চিকিৎসার জন্য গত ২ ডিসেম্বর তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে রাজধানীতে মেয়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় মুশতারী শফীকে। পরে গত ১৪ ডিসেম্বর শারীরিক অবস্থার আবার অবনতি হলে সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। ১৯ ডিসেম্বর তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার তিনি মারা যান।
মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার স্বামী মোহাম্মদ শফী এবং ছোট ভাই এহসানকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর পরিবার একাত্তরে চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরোসময় তিনি ওই বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেন।
এছাড়া বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একযুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার বেগম মুশতারী শফী দেশে প্রগতিশীল চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য তাকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০১৬ সালে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করা হয়।