
চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পী (৩৩) হত্যা মামলায় স্ত্রী রাশেদা বেগম (২৭) ও হুমায়ুন রশিদ (২৮) নামে দুইজনেক ফাঁসি ও অপর ৩ আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও ২ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার আসামি জাকির হোসেন ওরফে মোল্লা জাকিরকে (৩৫) খালাস দিয়েছেন আদালত।
আজ বুধবার (২৬ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত স্ত্রী রাশেদা বেগম কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার উত্তর লক্ষ্যারচর এলাকার মন্ডল পাড়ার জাকির হোসেনের মেয়ে এবং হুমায়ুন রশিদ পটিয়া থানার শোভনদন্ডী এলাকার হারুনুর রশিদের ছেলে।
রায় ঘোষণার আগে আসামি আল আমিন ও পারভেজকে কারাগার থেকে আদালত হাজির করানো হয়। রায় ঘোষণা শেষে তাদেরকে পুনরায় কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি আসামিরা জামিনে গিয়ে পলাতক রয়েছেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ৩ আসামী হলেন- আল আমিন (২৮), আকবর হোসেন ওরফে রুবেল ওরফে সাদ্দাম (২৩) এবং মো. পারভেজ ওরফে আলী।

রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে আদালতের বেঞ্চ সহকারী নেছার আহম্মেদ।বলেন, পাঁচজন আসামির মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদা বেগম, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আল আমিন ও আকবর হোসেন পলাতক রয়েছে। রায়ের সময় আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হুমায়ুন রশিদ ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মো.পারভেজ আলী এবং খালাস পাওয়া জাকির মোল্লা উপস্থিত ছিলেন। পরে হুমায়ুন রশিদ ও মো.পারভেজ আলীকে সাজা পরোয়ানা মূলে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর দুলাল চন্দ্র দেবনাথ বলেন, রায়ে দুই আসামিকে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। বাকি আসামি তিন আসামিকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, বাপ্পী ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বারের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তার গ্রামের বাড়ি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার চৌমুহনী এলাকায়। তার বাবার নাম আলী আহমেদ। মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বাপ্পী। হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তিনি অবিবাহিত ছিলেন বলে জানতেন আত্মীয়-স্বজনরা।
২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর নগরের চকবাজার থানার কে বি আমান আলী রোডে বড় মিয়া মসজিদের সামনে একটি ভবনের নিচতলার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় তার হাত-পা ও মুখ টেপ দিয়ে মোড়ানো এবং স্পর্শকাতর অঙ্গ কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘটনার পর বাপ্পীর বাবা আলী আহমেদ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
এদিকে বাপ্পী হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। আইনজীবীদের আন্দোলনের মুখে টানা অভিযান চালিয়ে ঘটনার দুদিন পর ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে রাশেদা বেগমসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একই সঙ্গে মামলাটি পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট অধিগ্রহণ করে পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে। এরপর তিনি তদন্ত করে বের করেন হত্যার নেপথ্যের কাহিনি।
যে বাড়ি থেকে বাপ্পীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সে বাড়ির কেয়ারটেকার ওই সময়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই নারী (রাশেদা) তার স্বামীসহ থাকবেন বলে বাসা ভাড়া নেন। ঘটনার রাতে ওই বাসায় থাকতে যান বাপ্পি। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
তদন্তকারীরা জানান, দেলোয়ার নামে এক ইয়াবা পাচারকারীর স্ত্রী ছিলেন রাশেদা বেগম। স্বামীর মামলার সূত্র ধরে আইনজীবী বাপ্পীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তারা গোপনে বিয়ে করেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মো. আবদুর রশিদ বলেন, বাপ্পি হত্যা মামলায় মোট ৩২ জন সাক্ষী ছিলেন। আদালত ২৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। আদালত সাক্ষী ও প্রমাণের ভিত্তিতে দুজনের মৃত্যুদণ্ড, তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং একজন আসামিকে খালাস দিয়েছেন।
হত্যার মূল কারণ :
মাদক মামলার আসামি দেলোয়ার হোসেন ছিলেন আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীর মক্কেল। দেলোয়ার জেলে যাবার পর তার জামিন নিতে গিয়ে স্ত্রী রাশেদা যোগাযোগ করেন বাপ্পীর সঙ্গে। সেই সম্পর্কের সূত্রে বাপ্পী গোপনে বিয়ে করেন রাশেদাকে, কিন্তু স্বীকৃতি দেননি। সম্প্রতি বাপ্পীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার পরিবার মেয়ে খুঁজছিল। বিষয়টি শুনে রাশেদা সামাজিক ও পারিবারিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন।
বারবার চেষ্টা করেও বাপ্পীর কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে না পেরে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেন রাশেদা। কাবিননামার টাকা বাড়িয়ে বাপ্পীকে বাধ্য করার কৌশল নেন। সেই কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বন্ধু হুমায়ূনকে নিয়ে বাপ্পীকে খুন করে ফেলেন রাশেদা, সঙ্গে ছিলেন আরো চারজন।
বাপ্পী খুনের ঘটনায় রাশেদা বেগমসহ (২৭) ছয়জনকে আটকের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খুনের কারণ সম্পর্কে বলেছেন পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মেট্রো) মো.মঈন উদ্দিন।
পিবিআই এই হত্যাকাণ্ডকে পূর্বপরিকল্পিত বলে জানালেও রাশেদা সে সময় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, বাপ্পীকে খুনের কোন পরিকল্পনা তার ছিল না। বন্ধু হুমায়ূনের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে ভয় দেখিয়ে কাবিননামার টাকা ২ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করার পরিকল্পনা তারা করেছিল।
‘হুমায়ূন তিন বছর ধরে আমার বন্ধু। আমি তাকে বলেছি, বাপ্পীর জন্য তো মেয়ে খুঁজছে, আমি এখন কি করব? তখন হুমায়ূন আমাকে পরামর্শ দিয়েছে কাবিননামার টাকা বাড়িয়ে নিতে পারলে বাপ্পী আমাকে মেনে নেবে। তখন আমরা বাপ্পীকে ভয় দেখানোর পরিকল্পনা করি।
পিবিআই কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন বলেন, বাপ্পী গোপনে বিয়ে করে রাশেদাকে স্বীকৃতি দেননি। তিনি রাশেদার সঙ্গে সংসার করতে চান না। অন্যদিকে রাশেদা তাকে ছাড়তে চান না। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে দুইটা মামলাও করেছেন। বাপ্পী ভূয়া তালাকনামা আদালতে দাখিল করে জামিন নেন। এসব বিষয় থেকেই মূলত দ্বন্দ্ব এবং হত্যাকাণ্ড।
পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে হুমায়ূনকে ভাই সাজিয়ে রাশেদা ২০ নভেম্বর বাকলিয়ায় কে বি আমান আলী রোডের বাসাটি ভাড়া নেয়। ওই বাসায় ঘটনার দিন (২৪ নভেম্বর) রাত ১০টার দিকে বাপ্পী এবং রাশেদা ছিলেন। এসময় হুমায়ূন অন্য চারজনকে নিয়ে ওই বাসায় যান। বাসায় ঢুকে রাশেদার বুকে ছোরা ধরার নাটক করেন। তখন বাপ্পী চিৎকার দিলে তার মুখ চেপে ধরে হাত-পা, মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বাপ্পীর আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে বাপ্পীর পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়।