
কামরুল ইসলাম দুলু, সীতাকুণ্ডঃ
ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কগুলোতে সারা বছরই দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং সেই সাথে হতাহতের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। যানবাহনের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়লেও সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের বাড়িতে হূদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার কারণে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। প্রতিদিনই একের পর এক প্রাণ ঝরছে। থামছে না সড়ক-মহাসড়কে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা। একটি দুর্ঘটনা শুধু প্রাণই কেড়ে নেয় না ,একটি পরিবারকে তছনছ করে দেয়। আর পঙ্গু হলে সারাজীবন এক ভয়াবহ করুণ জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, এই অপ্রতিরোধ্য ও প্রতিকারহীন সড়ক দুর্ঘটনা, এই অসহায় মৃত্যু ও আহতদের জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী কে বা কারা ?
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের গাড়ি চালকদের বেশিরভাগ অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত, অনেকের লাইসেন্স নেই, অনেকের লাইসেন্স ভুয়া। এদের হাতে গাড়ি ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। অথচ মালিকদের একাংশ সেটাই করছে। লাইসেন্স দেওয়ার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সেখান টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া হয়। গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলছে অগুণতি গাড়ি। সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। সেখানেও রয়েছে দুঃখজনক গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা। গত ১৮ নভেম্বর সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকরের ঘোষণা দেবার পর থেকে তা সংশোধনের দাবি তুলে সেদিন থেকেই পরিবহন ধর্মঘট ও কর্মবিরতি শুরু হয়। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ২০ নভেম্বর থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করে। তবে রাতেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
দুর্ঘটনা হতেই পারে। কিন্তু মহাসড়কে যে হারে ও যেভাবে হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। সন্তানহারা পিতা-মাতা আর স্বামীহারা বিধবাদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হচ্ছে। প্রতিবাদ শোনার যেন কেউ নেই। জবাবদিহির যেন কেউ নেই। প্রশাসন নীরব। প্রতিদিন মানুষ মারা পড়ছে। নাম মাত্র একটি মামলা রুজু করে সমাপ্তি। কোনো প্রতিকার নেই। আইনের অকার্যকারিতায় চালকের বা মালিকের কোনো সাজা বা জরিমানা নেই।
উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়েই সাধারণ মানুষের যানবাহনের চলাফেরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে সড়ক দূর্ঘটনা। গত শনিবার উপজেলার ফৌজদারহাট বাংলাবাজার বাইপাস মোড়ে ঘটে হৃদয়বিদায়ক ঘটনা। ঘাতক লরী কেড়ে নেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ন পরিচালক সাইফুজ্জামান মন্টুসহ দুই মেয়ের জীবন। এভাবে প্রতিদিনই উপজেলার কোথাও না কোথাও ছোট বড় দূর্ঘটনা ঘটছে। এদিকে ফৌজদারহাট – বন্দর বাইপাসের মোড়ে ট্রাফিক ব্যাবস্থা একেবারেই ঢিলেঢালা। এখানে ট্রাফিক পুলিশ বক্স থাকলেও কার্যক্রম তেমন নেই। যার ফলে এই জায়গাটাতে প্রতিনিয়ত সড়ক দূর্ঘটনা ঘটছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত তিনমাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশে বিভিন্ন ধরনের সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ৪০ জন। আহত হয়েছেন শতাধিকের বেশী। অনেক দূর্ঘটনার পর মামলা না হওয়ায় সেগুলো হিসাব পাওয়া যায়না।
দুর্ঘটনার ব্যাপারে সীতাকুণ্ডের বার আউলিয়া হাইওয়ে থানার ইনচার্জ মো. আব্দুল আওয়াল বলেন, এখানে দুর্ঘটনার জন্য গাড়ি চালকের ট্রাফিক আইন অমান্যই যেমন দায়ী কারণ তেমনি পথচারীদের অসচেতনতায়ও প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি আরও বলেন, আমার এলাকায় যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তারমধ্যে ৬০ শতাংশ প্রাণহাণি হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে তড়িঘড়ি মহাসড়ক পারাপার হতে গিয়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে মোবাইলে কথা বলতে বলতে সড়ক পারাপারেও প্রানহাণি হচ্ছে। তবে ট্রাফিক আইন অমান্যকারী যানবাহন ও গাড়ি চালকের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযান হচ্ছে। মামলা দায়ের করেছি আমরা। তবুও দুর্ঘটনা ঘটছে। আসলে সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন হলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অনেকাংশে কমতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এ যাবত বিস্তর আলোচনা হয়েছে। মিটিং-মিছিল, আন্দোলনও কম হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অপরাধীদের কারো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। অথচ প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনাই এখন প্রাণহানির কারণ হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপক বিস্তৃতির প্রধান প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে অপরাধীর লঘু শাস্তি, দুর্বল ট্রাফিক আইন ও আইন প্রয়োগে চরম শৈথিল্য, গাড়ি চালকদের অশিক্ষা, অদক্ষতা, অজ্ঞতা ও বেপরোয়া প্রবণতা, ফিটনেসবিহীন পুরনো গাড়ি, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনিয়ম-দুর্নীতি।