
লাখো মানুষের অংশগ্রহণে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফাজতের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরীর নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা উপস্থিত ছিলেন।
আজ বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) রাত ১১টা ২০ মিনিটে হাটহাজারী মাদ্রাসা মাঠে স্মরণকালের বৃহৎ এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাবু নগরীর মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। পরে
পরে রাত পৌনে ১২টায় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসা কবরস্থানে হেফাজতের সাবেক আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফির কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

এদিকে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর জানাজাকে কেন্দ্র করে রাত ১০টার পর থেকেই হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। হাটহাজারী মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ছাড়াও রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড, মিরেরসরাই, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাবুনগরীর হাজার হাজার ভক্ত, ছাত্র, হেফাজতের নেতাকর্মীরা জানাজায় অংশ নিতে হাটহাজারীতে আসেন। এতে মানুষের ঢল নামে। হাটহাজারী মাদরাসা ময়দান ছাড়িয়ে মুসল্লির কাতার বিস্তৃত হয় আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকায়। দুপুরের পর থেকে জানাযায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ হাটহাজারীতে আসতে থাকে। বিকেলের মধ্যে পুরে এলাকা জনসমুদ্রে রূপ নেয়। এলাকায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জানাযার আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বক্তব্য রাখেন।
বাবুনগরীর গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির বাবুনগরে তাকে দাফন করার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। সেখানে জানাযা এবং দাফনের প্রস্তুতিও ছিল। তবে হেফাজতের শীর্ষ নেতা ও মাদসার শিক্ষকদের সিদ্ধান্তে তাকে হাটহাজারী মাদরাসায় দাফন করা হয় বলে রাতে জানান হেফাজত নেতা মীর ইদ্রিস।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ৬৮ বছর বয়সী এই মজলুম আলেমকে অ্যাম্বুলেন্সে হাটহাজারী থেকে নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কিডনী, ডায়বেটিকস, হাই-প্রেসারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পাঁচ কন্যা, এক পুত্র সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
৬৭ বছর বয়সি দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেমে দ্বীন দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
২০২০ সালে হেফাজতের আমির হন জুনায়েদ বাবুনগরী। আমৃত্যু তিনি এই পদে ছিলেন। এর আগে তিনি এ সংগঠনের মহাসচিব পদে ছিলেন। তখন আমির ছিলেন প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফী।
বাবুনগরী হেফাজত আমিরের পাশাপাশি চট্টগ্রামের মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক পদেও ছিলেন।
তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি, চট্টগ্রাম নুরানি তালিমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুতাওয়াল্লি, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক, ইনসাফ২৪.কম ও কওমিভিশন.কমের প্রধান উপদেষ্টাসহ কয়েকটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তার মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের আলেম-উলামা, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ তৌহিদি জনতা হাসপাতাল এবং হাটহাজারী মাদরাসায় ছুটে আসেন।
তাকে শেষ বিদায় জানাতে হেফাজতের নেতাকর্মী, সমর্থকদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাটহাজারী মাদরাসায় আসেন। তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসা এবং জন্মস্থান উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগরে নেমে আসে শোকের ছায়া।
১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাবুনগরীর জন্ম হয়। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি জমিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সেখান থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে তিনি পাকিস্তান যান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা শেষে তিনি আরবি ভাষায় সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। সেখান থেকে তিনি হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশের মাদরাসাসমূহে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি এ মাদরাসার শায়খুল হাদিস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
অপরদিকে ২০১৩ সালে তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকালের পর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বরের হেফাজত আমির পদে মনোনীত হন। এরপর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল নানা কারণে ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গত ৭ জুন ৩৩ জনে উন্নীত হয়। ঈমান আকিদা রক্ষার আন্দোলনে অর্ধ শতাধিক মামলার আসামি হন প্রবীণ এ আলেমেদ্বীন আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী।
ভিডিও: