
চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে প্রাইভেটকার চালক শাহ আলমের বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশন (পিবিআই)।
ঘটনায় প্রধান আসামী শহিদুল ইসলাম কায়সার প্রকাশ বেলালসহ ২ জনেক গ্রেফতার করেছে পিবিআই।নগরীর ডাবলমুরিং থানার চৌমুহনী চাড়িয়া পাড়া থেকে গতকাল শনিবার দুপুর ২টার দিকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার শহীদুল ইসলাম কায়সার বেলাল ওই এলাকার বাসিন্দা। গ্রেফতার হওয়া বেলালের সহযোগীর নাম নুরুল আমিন রনি।
পিবিআই বলছে, তাদের মধ্যে বেলাল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন এবং হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছে।

আজ রবিবার (৩১ অক্টোবর) পিবিআই কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান। পিবিআই জানায়, স্বর্ণের বার পাচার সক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জেরে শাহ আলমকে ডেকে নিয়ে নেশা জাতীয় পানীয় খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর লাশ বস্তাবন্দি করে বাঁশখালীতে ফেলে দেয়া হয়। গত শুক্রবার বাঁশখালী উপজেলার চাঁনপুর বাজার পুরান ঘাট এলাকা থেকে প্রথমে বস্তাবন্দি অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধারের পর রাতে এটি কার চালক শাহ আলমের লাশ বলে শনাক্ত করে তার পরিবার। পরে বাঁশখালী থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে মামলা দায়েরের পর তদন্তে নামে জেলা পিবিআই টিম।
জানা যায়, শাহ আলম পেশায় গাড়ি চালক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ভাড়ায় প্রাইভেট কার-মাইক্রো চালান। পরিচয়ের সূত্র ধরে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার একজন কর্মকর্তা তিনি শাহআলমের গ্রামের প্রতিবেশি। গত এক সপ্তাহ আগে শাহ আলমকে প্রিমিও কারটি (চট্টমেট্টো-গ-১৩-৩০২৬) কিনে দেন।

নিহত শাহ আলম কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদের বেপারিপাড়া এলাকায় থাকতেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার গাড়ির চালক ছিলেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শাহাদাত হোসেন পাঠক ডট নিউজকে বলেন, ভাড়া মারতে গিয়ে পূর্ব পরিচিত শহীদুল ইসলাম কায়সার বেলাল একদিন দেখে শাহ আলম একটি সাদা প্যাকেট তার গাড়ীতে পাচার করছে। সে (বেলাল) ওই প্যাকেটে স্বর্ণের বার রয়েছে বলে সন্দেহ করে শাহ আলমকে বলে পরবর্তিতে এ ধরণের স্বর্ণের বার পাচারের সময় যেন তাকে বলা তাহলে সবাই মিলে সে স্বর্ণের বার ছিনতাই করবে। অথবা শাহ আলম যদি এ ধরণের স্বর্ণের বার পাচার করে তাহলে তাকে টাকার ভাগ দিতে হবে। মূলত এ থেকে চালক শাহআলমের সাথে আসামী বেলালের বিরোধ থেকে এ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
স্থানীয়ভাবে খবর নিয়ে জানাগেছে আসামী বেলালের যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। সে প্রভাবে চালক শাহ আলমের সাথে তার একাধিকবার বাকবিতণ্ডা হয়। এর জের ধরে শাহ আলমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে পিএবি সড়কে ফেলে আসে বেলাল। ওই সময় সে কারের নম্বর প্লেট খুলে ফেলে। বেলালের দেখানো মতে বাঁশখালী পুকুরিয়া খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত হাতুড়ি এবং

প্রাইভেটকারটি মীরসরাইয়ের মহুরীগঞ্জ হাইওয়ে থানা এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে পিবিআই।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ‘বাঁশখালীর পুকুরিয়ায় বস্তাবন্দি মরদেহ পাওয়া গেছে শুনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে যাই। মরদেহটি কিছুটা গলিত ছিল, তবুও তার আঙুলের ছাপ নেয়ার চেষ্টা করি। ছাপের মাধ্যমে জানতে পারি মৃত ব্যক্তির নাম শাহ আলম। তার বাবার নাম চান মিয়া। ঠিকানা দেয়া আছে আগ্রাবাদ ব্যাপারি পাড়া।’
তিনি জানান, পরে পরিবারের লোকজনকে খবর দেয়া হলে তারা মরদেহ শনাক্ত করেন। ওইদিন মধ্যরাতে নিহতের মেয়ে বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে বাঁশখালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্তে জানতে পারি ঘটনার চারদিন আগে নিখোঁজ হয়েছেন শাহ আলম। নগরীর কোতোয়ালি থানায় নিখোঁজ সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন শাহ আলমের পরিবার। শাহ আলম মূলত গাড়ি চালাতেন। ঘটনার দিন গাড়ি নিয়ে মালিককে শহর থেকে পটিয়া নেয়ার কথা। মালিকের দাবি, ২৬ তারিখ সকাল ১০ টার দিকে পটিয়া গিয়ে ভূমি অফিসে সারাদিন কাজ করে চারটার দিকে শহরের কোর্ট বিল্ডিং তাকে নামিয়ে দেন শাহ আলম। কল লিস্ট চেক করেও মালিকের সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় নি।’
পাঠক ডট নিউজের সঙ্গে আলাপকালে পিবিআই’র চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান জানান, শাহআলমের লাশ উদ্ধারের পর পিবিআই তদন্তে নেমে প্রথমে ‘শহর থেকে বের হওয়ার মুখের নতুন ব্রিজে এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করলাম আমরা। এতে দেখা যায় শাহ আলম যে গাড়ি চালাতেন, সেই গাড়িটি ২৬ আর ২৭ তারিখ মোট ৫ বার আসা-যাওয়া করেছে। এর মধ্যে ২৬ তারিখ গাড়িটির নম্বর প্লেট থাকলেও ২৭ তারিখ দেখা যাচ্ছে নম্বর প্লেট খোলা। এতে সন্দেহ হয় আমাদের। ২৭ তারিখ ৫ টা ২৮ মিনিটে গাড়িটি শহর থেকে বের হয়। আবার ওইদিন ৮ টা ২৬ মিনিটে বাঁশখালীর তৈলারদ্বীপ ব্রিজ পার হয় গাড়িটি। আবার ৮ টা ৩৮ মিনিটে তৈলারদ্বীপ ব্রিজ দিয়ে শহরের দিকে আসে।’
‘আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ও কল লিস্টের মাধ্যমে ২৭ তারিখ গাড়িটি যে চালিয়েছে তাকে শনাক্ত করি। তার নাম শহিদুল ইসলাম কায়সার প্রকাশ বেলাল। ৩০ তারিখ দুপুর ২টার দিকে ডবলমুরিংয়ের নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞেসাবাদ করলে খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি। পরে তাকে নিয়ে মরদেহ উদ্ধারের স্থানে গিয়ে খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত হাতুড়িটি উদ্ধার করি।’
মূলত ঘটনার দিন গাড়ির মালিককে নগরীর কোর্ট নামিয়ে দিয়ে শাহ আলম কর্ণফুলীর মইজ্জারটেকের আহসানিয়া পাড়ায়, আসামী বেলালের রড সিমেন্ট বিক্রয়ের দোকানে যায় বিরোধ মিটাতে। সেখানে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ‘কোমল পানীয়র সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে তারপর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানায় বেলাল। সে স্থান থেকে চালক শাহ আলমের সেন্ডেল, রক্তাক্ত একটি বস্তা, ঘুমের ওষুধসহ অন্যান্য আলামত জব্দ করা হয়।’
তদন্ত কর্মকর্তা এস আই শাহাদাত বলেন, ‘বেলালের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা নুরুল আমিন রনিকেও গ্রেফতার করি। প্রাথমিকভাবে বেলাল জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় বিদেশ থেকে বৈধ উপায়ে নিয়ে আসা স্বর্ণের বার শাহ আলমের গাড়িতে পরিবহন করা হতো। সেই তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। তথ্য দিয়ে সহযোগিতা না করায় ক্ষিপ্ত হন তিনি। এতেই শাহ আলমকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়।’ হত্যাকাণ্ডে মোট ৪ জন আংশ নিয়েছে। বাকীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।