
উলুধ্বনি, শঙ্খ, ঘণ্টা আর ঢাকঢোলের বাজনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা।
শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাঅষ্টমী ও কুমারী পূজা আজ। পঞ্জিকানুযায়ী সোমবার (৩ অক্টোবর) ৯টা ৪৯ মিনিটের মধ্যে দুর্গাদেবীর মহাঅষ্টমী কল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা প্রশস্তা ও মহাঅষ্টমীর ব্রতোবাস শুরু হয়।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসব। এর আগে সায়াংকালে দেবীর বোধন হবে।
হিন্দু পুরাণ মতে দুর্গাপূজার সঠিক সময় হলো বসন্তকাল কিন্তু বিপাকে পড়ে রামচন্দ্র, রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি বসন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শরতেই দেবীকে অসময়ে জাগ্রত করে পূজা করেন। সেই থেকে অকাল বোধন হওয়া সত্ত্বেও শরত কালে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম এবার জেলায় ২০৬২ পূজামণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব চলছে। যার মধ্যে ১৫৫৭টিতে প্রতিমা পূজা। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ-চট্টগ্রাম জেলা শাখার নেতারা এ তথ্য জানান।
নগরীর জেএমসেন হলে সবচেয়ে বড় পূজা মন্ডপে এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গা উৎসব। শারদীয় এ দুর্গাপূজাকে ঘিরে চার স্তরের নিরাপত্তা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকার ২৮২টি স্থানে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে। এই ২৮২টি মণ্ডপ ঘিরে সিএমপির নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে। নিয়মিত পোশাকের পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স, সোয়াত, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যরা। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, এবার পূজাকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট কোনও হুমকি নেই। কিন্তু আমরা যেকোনও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। গতবার জে এম সেন হলে হামলায় জড়িত ৭৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে তারা জামিনে চলে এসেছে। চট্টগ্রামে গত বছর দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলার যেসব আসামি জামিনে রয়েছে, তারা নজরদারিতে আছে।তিনি বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতসহ ৯টি স্থানে এ বছর প্রতিমা বিসর্জনের দিনে আলাদা নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন শেষ করতে হবে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত বলেন, শারদীয় দুর্গাপূজা ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে উদযাপনে সরকার ও প্রশাসনের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নিষ্ঠার সঙ্গে স্বধর্ম পালন এবং পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পূজার্থীসহ সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে আজ সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, পূজামণ্ডপগুলোতে শত শত নারী পুরুষের ভীড়। নগরীর পাথরঘাটায় শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ ও শান্তনেশ্বরী মাতৃমন্দিরে প্রতিবছরের মতো এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুমারী পূজা। কুমারী পূজার জন্য মাতৃভাবের পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে এবছর কুমারী মায়ের আসনে বসানো হয়েছে ৭ বছর বয়সী প্রীত ধরকে। কুমারীর বয়স ৭ বছর হওয়ায় মালিনী নামে পূজিত হন এবছর। শাস্ত্রমতে মালিনী নামে কুমারী পূজিত হলে ধৈনশ্বর্য লাভ হয়। প্রীত ধর সেন্ট স্কলাস্টিকাস স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করছেন। সকাল সাড়ে ১০টায় মাতৃরূপে ফুল, চন্দন, বেলপাতা, তুলশী পাতা দিয়ে শুরু হয় পূজা আর্চনা। পূজা কার্যক্রম পরিচালনা করেন শান্তন্বেশ্বরী মাতৃমন্দিরের পুরোহিত শ্রীমৎ শ্যামানন্দ দাস মোহন্ত মহারাজ।
পরে মন্দিরের পুরোহিত শ্রীমৎ শ্যামল সাধু মোহন্ত মহারাজ সাংবাদিকদের বলেন, কুমারী আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতীক। কুমারীরা শুদ্ধতার প্রতীক হওয়ায় মাতৃরূপে ঈশ্বরের আরাধনার জন্য কুমারী কন্যাকে নির্বাচিত করা হয়। মূলত নারীর যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্টিত করতে কুমারী পূজা করা হয়। মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তবরূপ কুমারী পূজা। কুমারীতে সমগ্রজাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি, পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তিসহ সকল কল্যানী শক্তি সুক্ষরূপে বিরাজিতা। দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা হলো অশুভ, অন্যায়, পাপ পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য ও সুন্দরের যুদ্ধ।
এছাড়া পূজামণ্ডপগুলোতে পুষ্পাঞ্জলি ও প্রসাদ বিতরণ শেষে বেলা সাড়ে ১০টায় কুমারী পূজা ও বিকাল ৪টা ৫ মিনিট থেকে ৪টা ৫৩ মিনিটের মধ্যে সন্ধিপূজার মধ্য দিয়ে শেষ হবে মহা অষ্টমীর আনুষ্ঠানিকতা।
এবছর চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান পূজামণ্ডপ জেএম সেন হলসহ ১৬টি থানায় ব্যক্তিগত, ঘটপূজাসহ ২৮২টি পূজামণ্ডপে পূজা উদযাপন হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় মোট দুই হাজার ৬২টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিমা পূজা এক হাজার ৫৮৭টি এবং ঘট পূজা ৪৭৫টি।
রবিবার রাতে নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক নেতা ও দেশে করোনা প্রতিরোধক বুথের উদ্ভাবক-উদ্যোক্তা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর।
এদিকে এবার সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে হীরক জয়ন্তী পালন করছে নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়া দুর্গোৎসব উদযাপন পরিষদ। এবার পূজার থিমের নাম দেওয়া হয়েছে পার্বণ।
আদিবাসীদের জীবনধারা ও কর্মযজ্ঞ তুলে ধরা হয়েছে এই থিমের মাধ্যমে। বাঁশ ও বেড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো মণ্ডপ। মণ্ডপে প্রায় ১৪ হাজার বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দৃষ্টিনন্দন এই পূজামণ্ডপ দেখতে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা।
শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাষষ্ঠীর দিন বিকেল ৫টায় নালাপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব বের করা হয় বর্ণাঢ্য র্যালি। ব্যানার, প্লেকার্ড, ঢাক-ঢোলসহ নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বের হওয়া র্যালিটি দক্ষিণ নালাপাড়া থেকে বের হয়ে সদরঘাট, নিউমার্কেটসহ নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক করে পুনরায় দক্ষিণ নালাপাড়া এসে শেষ হয়।
থিম পরিকল্পনাকারী রাজিব বিশ্বাস রাজা বলেন, এবার পূজার থিমের নাম হচ্ছে পার্বণ। আদিবাসীদের জীবনধারা ও কর্মযজ্ঞ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে এখানে। বাঁশ ও বাঁশের বেড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো পূজা মণ্ডপকে। মণ্ডপে প্রায় ১৪ হাজার বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। ভাবনা ও সৃজনে রয়েছেন বিশ্বজিৎ আইচ। পাঁচ মাস আগে থেকে আমরা এই কাজ শুরু করেছিলাম। দিন-রাত কাজ চালিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পেরে ভালো লাগছে। আশা করছি দর্শনার্থীদেরও কাছে আমাদের এই আয়োজন দৃষ্টিনন্দন হবে।