
শিবিরের কর্মী আখ্যা দিয়ে মধ্যরাতে চার ছাত্রকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) একটি ছাত্রাবাসে।
গুরুতর আহত অবস্থায় ওই চার ছাত্র বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ভয়ে আর আতঙ্কে ভুক্তভোগীদের পরিবার এমনকি থানায় মামলা করতেও সাহস পাচ্ছে না।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে এই ঘটনা ঘটেছে চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে। চার ছাত্র এখনো হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে, যাদের দুজন রয়েছে আইসিইউতে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ভুক্তভোগীদের আবার হুমকি দেয়া হয়েছে যেন তারা কারো কাছে অভিযোগ না করে।
তবে ছাত্রলীগের যে সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বক্তব্য, শিবির ঠেকানোর দায়িত্ব মনে করে তারা ওই শিক্ষার্থীদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তবে নির্যাতনে ঘটনা ঘটেনি।
এই ঘটনায় একটি তদন্ত গঠন করেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
সে রাতে যা ঘটেছিল:
নির্যাতনের শিকার চার শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও তারা নাম প্রকাশ করে গণমাধ্যমের কাছে বক্তব্য দিতে সাহস পাচ্ছে না। তবে সেদিনের নির্যাতনের শিকার দু’জনের সাথে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে।
তারা জানিয়েছেন, বুধবার রাত ১২টা থেকে প্রধান ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে শিবির সন্দেহে নির্যাতনের মহড়া শুরু হয়।
নাম না প্রকাশের শর্তে নির্যাতনের শিকার একজন ছাত্র বিবিসি বাংলাকে বলেন, ’রাত ৪টার দিকে তিনজন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। তিনতলার এ ব্লকের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে ঢোকার পরেই চেয়ারে বসিয়ে মারধর শুরু করে।‘
পাইপ, লাঠি, স্ট্যাম্প দিয়ে কয়েকজন মিলে তাকে বেধড়ক মারতে থাকে। দুই ঘণ্টা ধরে মারধর করার পর তারা একটি কাগজে স্বীকারোক্তি নেয় যে, তিনি শিবির করেন। মারধরের মুখে তিনি সেখানে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হন।
এই শিক্ষার্থী টিউশনি করেন। কিছুদিন আগে তার এক ছাত্রের সাথে তিনি একটি কোচিং সেন্টারে গিয়েছিলেন। তাকে নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের দাবি, ওই কোচিং সেন্টারটি শিবির কর্মীরা পরিচালনা করে। সেটার সাথে যারা জড়িত তারাও শিবির কর্মী।
’আমি কোনো রাজনীতির সাথেই জড়িত নই, কখনো রাজনীতিই করিনি। কিন্তু তারা শুধু ওই কথার ভিত্তিতে আমাকে মেরেছে,’ বলেন তিনি।
সেদিন রাত ১২টা থেকে এভাবে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল বলে তিনি জানান। এর আগেও এই হোস্টেলে এরকম মারধর করা হয়েছে।
এরপর ভোরের দিকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে প্রথমে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এখন তিনি সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আরেকজন শিক্ষার্থীর স্বজনরা জানিয়েছেন, এই ঘটনা আলোচিত হওয়ার পর ছাত্রলীগের একদল কর্মী হাসপাতালে এসে তাদের হুমকি দিয়ে গেছে যেন এসব বিষয়ে কারো সাথে কথা বলা না হয়।
তিনি বলেন, ’আমরা তো খুব ভয়ের মধ্যে আছি। কি করবো, কার কাছে যাবো। কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা এই ঘটনা তদন্ত করে দেখছে। সেই পর্যন্ত আমাদের একটু চুপচাপ থাকতে বলেছে।‘
বৃহস্পতিবার ভোররাতে এই নির্যাতনে কথা জানতে পেরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা ছাত্রাবাসে গিয়ে দুই ছাত্রকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
হুমকির ঘটনা জানার পর চট্টগ্রাম হাসপাতালের আইসিইউতে যে দুজন আহত শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে, তাদের নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গত অক্টোবর মাসেও এভাবে এক শিক্ষার্থীকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে বুয়েটে এরকম নির্যাতনের পর তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল, যা সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় তৈরি করেছিল।
সেই ঘটনায় বুয়েট ছাত্রলীগের ২০ নেতা-কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কী বলছে:
এই নির্যাতনের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ছাত্রলীগের বর্তমান ও বহিষ্কৃত কয়েকজন নেতা-কর্মী।
তাদের একজন অভিজিৎ দাস নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ’আমরা কাউকে মারধর করিনি। আমরা চারজন শিক্ষার্থীকে সন্দেহ করে তাদের মোবাইল চেক করে জামায়াত-শিবির সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পাই, ওদের সাথে সম্পৃক্ততার বিভিন্ন প্রমাণ পাই, তাদের রুমে জিহাদি বইপত্রও পাই। ওগুলোর সব ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আছে। সেগুলো আমরা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়েছি। পরে আমরা জানতে পারি, ওরা হাসপাতালে ভর্তি আছে।‘
কর্তৃপক্ষ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকার পরেও কেন তারা নিজেরা এসব তল্লাশি করতে গিয়েছেন, জানতে চাইলে অভিজিৎ দাস বলেন, ’যেহেতু তারা এখানে জিহাদি বই বিতরণ, বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে অবশ্যই এগুলো তদারকি করা এগুলো আমাদের দায়িত্ব।‘
আমরা ওদের সন্দেহ করেছিলাম, ’আমরা ওদের ডকুমেন্টগুলো কালেক্ট করেছি, শিবিরের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব। এই হিসেবে আমরা এগুলো করেছি। তবে মারধর বা নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটাইনি। নিজেরা সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য ওরা এগুলো করতেছে।‘
তিনি দাবি করেন, মোট ১৮ জন শিবিরের সাথীকে তারা শনাক্ত করেছেন।
তবে নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেও চমেকের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ২০২১ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের একটি ঘটনার পর অভিজিৎ দাসসহ আরো কয়েকজনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। চমেকে এরপর ছাত্রলীগের কোনো কমিটিও দেয়া হয়নি।
কী বলছে চমেক কর্তৃপক্ষ:
নিজেদের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তাদের সহপাঠীরা ঘোষণা দিয়েছেন, নিপীড়ক ছাত্রলীগ কর্মীদের শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত তারা ক্লাসে যাবেন না।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা: শাহানা আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই ঘটনায় তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর একাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
’ঘটনা শোনার পর ওদের উদ্ধারের জন্য বয়েজ হোস্টেলে গিয়েছিলাম। প্রধান ছাত্রাবাস থেকে থেকে দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি, যারা এখনো চিকিৎসাধীন আছে। আর দুজন বাড়িতে গিয়েছিল, তাদেরও সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে,’ বলেন তিনি।
তবে তিনি জানান, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি মুখ খুলতে চাইছে না।
’যারা আহত হয়েছে, তারা সরাসরি কারো নাম বলেনি। আমরা মিডিয়া থেকে অনেক কিছু জানছি। তদন্ত কমিটি ওদের সাথে কথা বলেছে। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের অনেকের হোস্টেলে বৈধ সিটও নেই। তারা এখন হোস্টেলেও নেই। তারা কিভাবে কাদের সহায়তা হোস্টেলে এসেছিল, সেটাও আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি,‘ বলেন অধ্যাপক শাহানা আক্তার।
আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘যারা আহত, তারা এখনো ওভাবে মুখ খুলছে না বা আমাদের হেল্প করছে না। যদিও ওরা কোনো স্টেটমেন্ট দেয়, তাহলে আমরা হয়তো আগাতে পারি।‘
এই বিষয়ে চকবাজার থানা ওসি মনজুর কাদের মজুমদার জানিয়েছেন, তাৎক্ষণিক সংবাদ পাওয়ার পর পুলিশের টিম হোস্টেলে গিয়েছিল। কিন্তু থানায় কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। তবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি