
নিজের পরকিয়া প্রেম ধামাচাপা দেয়া এবং সেই প্রেমিকের হাত থেকে নিজের মেয়েকে রক্ষা করতেই পরিকল্পনা করে খুন করা হয় প্রেমিক শহীদুল ইসলাম (২৩) কে। ঘটনার সাড়ে তিন বছর পর ক্লু বিহীন এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা টিমের হাতে গ্রেফতার হয়ে আদালতে দেয়া ১৪৬ ধারায় জবান বন্দীতে হত্যার কথা স্বীকার করেন প্রীতি বণিক প্রকাশ নমিতা প্রকাশ মুক্তা (৪৫) ।
মূলত আদালতের সন্দেহ থেকেই এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। এর আগে মামলাটি দুই দফায় তদন্ত করে পুলিশ এবং সিআইডি। এ দুফায় তদন্তেই আদালতে একই রিপোর্ট দাখিল করে সিআইডি এবং পুলিশ। দুটি চার্জশীটেই বিচারকের সন্দেহ হয়। তখন তৃতীয় দফায় মামলাটির তদন্তভার ন্যাস্ত করা হয় পিবিআই’র উপর।
মামলাটিতে যে ক্লু ছিল তা দিয়ে তিন বছরে দু দফায় তদন্ত করেও কোন রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছেন আইনশৃংখলা বাহিনীর এ দুটি ইউনিট। অথচ একই ক্লু দিয়ে মাত্র ২৮ দিনেই ঘটনার রহস্য উম্মোচন করেছে পিবিআই’র মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. আবদুর রাজ্জাক। শুধু রহস্য উদঘাটনই নয় মামলার সাথে জড়িত মূল দুজন আসামী প্রীতি বণিক (৪৫) এবং তার ভাই রাজু ধর (২৫) কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন পুলিশের এ বিশেষায়িত ইউনিটটি।

পিবিআই’র পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, সাড়ে তিন বছর আগে ২০১৩ সালের ৮ আগষ্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় শহিদুল ইসলাম (২৩) নামে খুন হওয়া এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। উপজেলার ঢেমশা রোডের চিকন খালের পাড়ে কবরস্থানের পাশে লাশটি পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা তখন পুলিশকে খবর দিয়েছিল।
লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে অপমৃত্যু মামলা দায়ের হলেও এক বছর পর ২০১৪ সালে ময়না তদন্ত রিপোর্টে মাথায় আঘাতজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ থাকায় নিয়মিত মামলা দায়ের করে পুলিশ।
লাশ উদ্ধারের সময় মৃত শহীদুলের ব্যাগে তিনটি মোবাইল নাম্বার পাওয়া গেলেও সে মোবাইল নাম্বার ব্যবহারকারী প্রীতি বণিককে থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদেই দায়িত্ব শেষ করে পুলিশ। তার মোবাইল নাম্বার এ নিহত যুবকের কাছে কেন লেখা ছিল বা তার সাথে কি সম্পর্ক কিছুই জানতে চাওয়া হয়নি। একই অবস্থা সিআইডি পুলিশেরও। তারা মোবাইল নাম্বারের জের ধরে প্রীতি বণিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিন্তু কোন ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি। ফলে খুন করেও অনেকটা স্বাভাবিকই ছিলেন প্রীতি বণিক।
পুলিশ পরিদর্শক রাজ্জাক আরো জানান, তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। মামলা তদন্তের ক্লু হচ্ছে সেই তিনটি মোবাইল নাম্বার।
তম্মধ্যে দুটি নাম্বার বন্ধ থাকলেও একটি সচল ছিল। যেটি দিয়ে সনাক্ত করা হয় প্রীতিকে। তবে পুলিশের ফোন পেয়েই অনেকটা স্বাভাবিক মনেই পিবিআই অফিসে আসেন প্রীতি। তাঁর আচরণ ছিল অনেকটা স্বাভাবিক জানান পিবিআই’র কর্মকর্তারা।

প্রথমে এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে কিছু না বললেও পরবর্তীতে পিবিআই’র বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে হয় প্রীতিকে। এক পর্যায়ে সব স্বীকার করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। এর পর মঙ্গলবার বিকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়ন্তী রানী রায়ের আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবান বন্দিতে নিজের অপরাধের কথা তুলে ধরেন প্রীতি।
পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, শহিদুলের ব্যাগে প্রীতির তিনটি মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। সেই নম্বরের সূত্র ধরে আমরা তাকে শনাক্ত করি। শহিদুলের সঙ্গে মধ্যবয়সী প্রীতির ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিন সন্তানের মা প্রীতি সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাতে গিয়ে তার ভাই রাজু বণিককে নিয়ে খুন করে শহিদুলকে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে প্রীতি জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে মোবাইলে ক্রস কানেকশনে শহিদুলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। খুলনা বাগের হাট সদর এলাকার বাসিন্দা গফুর শেখের ছেলে শহিদুল টঙ্গী এলাকায় একটি পোশাক কারকানায় চাকুরি করত। আর প্রীতি থাকেন চট্টগ্রামে। প্রীতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয় ২০১৩ সালে। ছোট মেয়ে এসএসসি পাশ করার পর পড়ালেখা বন্ধ । আর ছেলে কলেজে পড়ে।
পরিচয়ের পর কয়েকবার চট্টগ্রামে এসে শহিদুল প্রীতির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি প্রীতিকে মুক্তা নামে চিনতেন। শহীদুল চট্টগ্রামে আসার পর দুই তিনবার তার মেয়ে সহ শহীদুলকে রিসিভ করেন চট্টগ্রামের অলংকার মোড়ে। এ ছাড়া শহীদুল মাঝে মাঝে তার মেয়ের সাথেও কথা বলতেন মোবাইলে। প্রীতিই মেয়েকে শহীদুলের সাথে কথা বলতে দিতেন।
এর মধ্যে প্রথম এবং দ্বিতীয় দফায় যখন শহীদুল চট্টগ্রামে আসেন তখন সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে মেডিকেলে ভর্তি করে চিকিৎসা করান প্রীতি। এসময় প্রীতি এবং তার মেয়ে শহীদুলের সাথে হাসপাতালে রাত্রি যাপন করেন।
প্রীতি তার জবান বন্দিতে জানান, পরিচয়ের পর থেকে বিভিন্ন অজুহাতে শহিদুল তার কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা নেন। এর মধ্যে প্রীতি তার স্বামীর অজান্তে নিজের ব্যবহার্য স্বর্ণ বন্ধক দিয়ে শহীদুলকে টাকা দেন। পরে পাওনা টাকা ফেরত চাইলে দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এতে বেঁকে বসে শহীদুল। শুরু করে প্রীতিকে ব্ল্যাক মেইল করার চেষ্টা। শহীদুল পূর্বেও টাকা ফেরত না দিয়ে পূনরায় প্রীতিকে টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এতে প্রীতি অস্বীকৃতি জানালে শহীদুল তাদের দুজনের সম্পর্কের কথা প্রীতির স্বামীকে জানিয়ে দিবে বলে হুমকি দিতে থাকে।

এ ছাড়া শহীদুলের কাছে তাদের পরকিয়া সম্পর্কের ভিডিও এং অডিও ফাঁস করে দেয়ারও হুমকি দেয়। তাতেও প্রীতি রাজি না হলে সর্বশেষ প্রীতির ছোট মেয়ের সাথে শহীদুল অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং মেয়ের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেবে বলে হুমকি দিতে থাকে। প্রীতি শহিদুলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে চাইলে বিরোধ আরো জোরালো রূপ নেয়। এতে করে প্রীতির মনে ভীতির সৃষ্টি হয় । তখন সে পরিকল্পনা শুরু করে কিভাবে শহীদুলকে সরিয়ে দেয়া যায়।
এক পর্যায়ে প্রীতি তার ভাই রাজুর সঙ্গে পরামর্শ করে শহিদুলকে ২০১৩ সালের আগষ্টে কৌশলে চট্টগ্রামে আনে। প্রীতি জানায়, প্রথমে শহীদুলকে হত্যার পরিকল্পনা না থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল শহীদুলকে শেষবাওে মত বুঝিয়ে এ সম্পর্কেও যবনিকা টানবে। কিন্তু শহীদুল যখন চট্টগ্রাম আসে নগরীর অলংকার মোড়ে তাকে এ নিয়ে অনেক বোঝানো হয়। তখন প্রীতি বলে যে আসলে মুক্তা নামে কেউ নেই। প্রীতিই মুক্তা নামে তার সাথে অভিনয় করেছিল। প্রীতি জানান, যে আমি হিন্দু তুমি মুসলিম, এছাড়া প্রীতির তিনটি ছেলে মেয়ে আছে এবং বয়সের তারতম্যেও শহীদুলের সাথে প্রীতির কোন সম্পর্ক হয়না। কিন্তু শহীদুল তো নাছোড় বান্দা। তখন প্রীতি তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করে।
এরপর নগরীর বহদ্দার হয়ে সাতকানিয়ায় প্রীতির বাপের বাড়ী যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেন তারা। সেখানে প্রীতির পালক বাপের বাড়ী। কেরানিহাট গিয়ে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে সময় অতিবাহিত করে। এ ফাঁকে প্রীতির ভাই রাজু দোকান থেকে একটি রডের মাথা কিনে তা পেপার মুড়িয়ে নেয়। রাতে শুরু হয় প্রীতির বাপের বাড়ীর উদ্দেশ্য হেটে পথ চলা। এক পর্যায়ে চিকন খাল কবরস্থান এলাকায় গেলে প্রীতির ভাই রাজু শহীদুলকে পিছন থেকে রড দিয়ে মাথায় পর পর দুটি আঘাত করে। এতে মাটিতে লুটে পড়ে শহীদুল। তখন প্রীতি তাকে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে। শহীদুলের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরই তারা সেখান থেকে চলে আসেন।
এদিকে প্রীতি এর আগে আরো বেশ কয়েকজন লোকের সাথে এ ধরণের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল বলে জানা গেছে। প্রীতির স্বামী নগরীর মিস্ত্রি পাড়া এলাকায় স্বর্ণের ব্যবসা করেন।
এদিকে শহীদুলের পারিবারিক অর্থিক অবস্থা এতই দুর্বল ছিল যে তার লাশ পর্যন্ত গ্রামে নিতে পারেনি পরিবার। পরে লাশ চট্টগ্রামে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম দাফন করেন।