
চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর এবং ক্লু বিহীন মামলার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) ই একমাত্র ভরসা। মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ চাঞ্চল্যকর মামলা সুরাহা করতে এখন পিবিআই’র দিকেই ঝুঁকছে বেশী। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টিরও বেশী ক্লু বিহীন মামলার রহস্য উদঘাটন করে ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষের আস্থার ঠিকানায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছে পুলিশের এ বিশেষায়িত সংস্থাটি।
পাশাপাশি পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র প্রতি দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে বিভিন্ন মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ। এতে করে পুলিশের এ দুটি ইউনিট অতীতের সুনাম হারাতে বসেছে।
চট্টগ্রামে গত এক বছরে যেখানে পুলিশ এবং সিআইডি ব্যর্থ সেখানেই সফল হয়েছে পিবিআই। একই ক্লু নিয়ে পুলিশ এবং সিআইডি ব্যর্থ হলেও ঠিক একই ক্লু দিয়েই মামলার রহস্যের জট খুলেছে পিবিআই। ফলে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সর্বত্রই এখন পিবিআই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি এখন খোদ আদালত স্ব প্রনোদিত হয়েই চাঞ্চল্যকর সব মামলার পূন:তদন্তের দায়িত্ব দিচ্ছেন পিবিআইকে।
গত ১২ ডিসেম্বর নগরীর কর্ণফুলী থানায় চাঞ্চল্যকর ডাকাতি ও চার নারী ধর্ষনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পুলিশ রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়। সংবাদ সম্মেলন করে অনেকটা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করে পুলিশ। এর পর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পিবিআইকে। গত ২৬ ডিসেম্বর আদালত কর্তৃক তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই যেন আদাজল খেয়েই মাঠে নামে পিবিআই’র চৌকস একটি টিম।
২৪ ঘন্টার মধ্যেই এ ঘটনার সাথে জড়িত মূল হোতাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হন সংস্থাটি। অথচ পুলিশ এর আগে এ ঘটনায় জড়িত মর্মে তিন নিরীহ যুবককে গ্রেফতার করেছিল। পিবিআই বলছে পূর্বে পুলিশের হাতে গ্রেফতার তিন যুবক ঘটনার সাথে জড়িত নয়। এ ঘটনায় পিবিআই’র হাতে আটক তিনজন ইতোমধ্যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
এ ছাড়া গত ৩ জানুয়ারী সাড়ে তিন বছর আগের গার্মেন্টস শ্রমিক শহীদুল হত্যার রহস্য উদঘাটন সহ এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত দু’জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পিবিআই।

এ ছাড়া গেল বছর ৩০টিরও বেশি ক্লু বিহীন চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটন করে আসামীদের গ্রেফতার করেছে সংস্থাটি। পিবিআই মূলত সেই সকল ক্লু বিহীন মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে যেগুলো পুলিশ ও সিআইডি উদঘাটন করতে ব্যার্থ হয়েছে।
কখনো আদালত স্বপ্রনোদিত হয়ে,কখনো মামলার বাদীর আরজির প্রেক্ষিতে এসব মামলার তদন্তের দায়িত্ব নেন পিবিআই।
সম্প্রতি পিবিআই’র চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার জুলফিকার আলী হায়দারের সাথে একান্ত আলাপকালে তিনি পাঠক ডট নিউজের সাথে আলাপকালে তুলে ধরেন তাঁদের বেশ কয়েকটি সাফল্যের তথ্য।
তিনি জানান, আদালতের নির্দেশ কিংবা থানা পুলিশের অনুরোধ অথবা বাদীর ইচ্ছায় ক্লু-বিহীন চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে পিবিআইর উর্দ্ধতন থেকে অধস্থন কর্মকর্তা সবাই একযোগে কাজ করে।
মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে টিম ওয়ার্ক, পেশার প্রতি একাগ্রতা, বুদ্ধিমত্তা, মামলার তথ্য উপাত্তের প্রতি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষন এবং কারিগরি সহায়তাই তাদের সফলতার মূল নেপথ্যে কারণ বলে জানান পিবিআই’র এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
পিবিআই বিগত এক বছরে যে সব চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটন করেছে সে গুলো হলো – গত বছরের অক্টোবরে নগরীর চক্ষু হাসপাতালের সামনে মাকে দেখতে এসে ছিনতাইকারীদের হামলায় নিহত হয় নাছির উদ্দিন হত্যা মামলা। এ মামলায় পুলিশের ব্যর্থতার পর তদন্তভার পেয়েই ইমরান হোসেন বাপ্পী ও মো: সুমন নামে দুই ছিনতাইকার কে ছিনতাইকৃত মালামালসহ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সংস্থাটির চৌকস পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা।
একই বছরের নভেম্বরে নগরীর ডবলমুরিং এলাকায় থেকে ব্যবসায়ী হাজী জালাল উদ্দিন হত্যা মামলায় চার আসামীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পিবিআই ।
জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শান্তি নিকেতন বাজারে ডাকাতিকালে ডাকাত দলের হাতে উত্তম বিশ্বাস হত্যার ঘটনায় পুলিশ ব্যর্থ হলেও সেখানেও সফল পিবিআই। এ হত্যা মামলার রহস্য উম্মোচন করে হত্যাকান্ডে জড়িত ছয় ডাকাতকে গ্রেফতার।
২৯ জানুয়ারী নগরীর কালামিয়া বাজার এলাকায় সোহেল হত্যা মামলায় রহস্য উম্মোচন করে হত্যাকান্ডে জড়িত তিন আসামীকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
২০১৭ সালের জুন মাসে খাগড়াছড়ি সদরে মহেন্দ্র সমিতির লাইনম্যান ও চালক নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার পুলিশ রহস্য উম্মোচনে ব্যার্থ হয় । পিবিআই’র পরিদর্শক সন্তোষ চামকা নেতৃত্বে একটি চৌকশ দল মামলাটি তদন্ত করে রহস্য উদঘাটনের পর হত্যাকান্ডে জড়িত দুই আসামীকে গ্রেফতার করে।
গত বছরের মার্চে নগরীতে মা ও তার কথিত প্রেমিক মিলে ২ বছর বয়সী শিশু মারিয়াকে গলা টিপে হত্যার পর লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জুতার বাক্সে লুকিয়ে রাখার ঘটনায় আসামীদের গ্রেফতার করা হয়।
একই বছরের জুন মাসের নগরীর দামপাড়া এলাকা থেকে এক যাত্রীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানা পুলিশ ছিনতাইকারীকে সনাক্ত করতে না পারায় পিবিআই পরিদর্শক নুর আহমেদ মামলাটি তদন্ত পূর্বক ছিনতাইকারীদের সনাক্ত করে ছয় আসামীকে গ্রেফতার করে।
২০১৭ সালের মার্চে চট্টগ্রামের ভুজপুরে মনোয়ারা বেগমকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে তারই ভাসুর আবদুস সালাম ও ভাসুর পুত্র আবদুল খালেক। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করে কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। পরবর্তীতে পিবিআই একটি চৌকস দল ঘটনার রহস্য উদঘাটনের পর আসামীদের গ্রেফতার করে।
গত ঈদুল ফিতরের রাতে আনোয়ারার গোড়া বাজারে মুদি দোকানী আহমেদ কবির হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করে আসামীদের গ্রেফতার করে পিবিআই’র পরিদর্শক মেখ এহতেশামুল ইসলাম ।
নগরীর চকবাজার কেবি আমান আলী রোডে গত ২৪ নভেম্বর তরুন আইনজীবি ওমর ফারুক বাপ্পি হত্যার ঘটনায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করে পিবিআই। এঘটনায় জড়িত বাপ্পির কথিত স্ত্রী ও ইয়াবা সুন্দরী রাশেদাসহ সকল আসামীকে গ্রেফতার করা হয়।
গেল বছর কক্সবাজারে সংগঠিত একটি হত্যা মামলার আসামী মো: আজমকে সনাক্ত করে গ্রেফতার করে পিবিআই। গত বছরের ২৬ আগষ্ট ঢাকা শেরেবাংলা নগর থানার একটি প্রতারণা মামলার আসামী ইমাম হাসানকে চিহিৃত করে চট্টগ্রাম আগ্রবাদ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
ঠাকুরগাঁওয়ের একটি শো রুম থেকে ১৯ লক্ষ টাকার মালামাল চুরি করার ঘটনায় আসামীদের চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার, ৯ অক্টোবর বাউফল থানার একটি মামলার প্রধান আসামী সুমন হাওলাদারকে গ্রেফতারসহ আরো প্রায় ২০টি গুরুত্বপূর্র্ণ মামলার তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে আসামীদের গ্রেফতার করেছে পুলিশের এ বিশেষ সংস্থাটি।
পিবিআই’র পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমরা যে কোন মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমেই মামলার এজাহারসহ অন্যান্য তথ্যগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ি। মামলার নথিপত্রের সাথে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত গুলোকে খুবই সতর্কতার সাথে বিচার বিশ্লেষন করি। এর পর সে সব বিষয় নিয়ে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে কাজ শুরু করি। তিনি জানান, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারাটাই সফলতার অন্যতম প্রধান কারন।
পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, আমরা সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করি প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের ধরতে। আমাদের কর্মকর্তারা চেষ্টা করেন নিজেদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠার সাথে টিম ওয়ার্ক করার জন্য।
তিনি বলেন, পেশাদারিত্ব আর মেধা থাকলে যে কোন ধরনের কঠিন মামলাই সুরাহা করা সম্ভব। একাকি কাজ না করে সকলে মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করলে সফলতা আসবেই। এ ছাড়া কারিগরি সহযোগিতা তো প্রয়োজন আছেই। তবে এ মুহুর্তে পিবিআই’র কোন ধরনের কারিগরি সমস্যা নেই বলেও জানান তিনি। যে পরিমাণ জনবল এবং লজিস্টিক সহায়তা রয়েছে তাতে করে যে কোন ধরনের জটিল মামলার রহস্য উদঘাটনে কোন বেগ পেতে হয়না পিবিআইকে।
পিবিআই সকল জটিল মামলার রহস্য উদঘাটনে সফল হচ্ছে পুলিশ বা সিআইডি কেন ব্যর্থ এমন প্রশ্নের জবাবে জুলফিকার বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা মামলা তদন্তে পর্যাপ্ত সময় এবং সাপোর্ট পাননা। তাঁদেরকে মামলার কাজ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। ফলে একটি মামলা তদন্তে যে ধরনের সময় এবং মেধা ব্যয় করার কথা তা নানা প্রতিকুলতার কারণে পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়না।
এছাড়া সিআইডির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বলে দাবী তাঁর। সিআইডিতে যারা মামলা তদন্ত করেন তাঁরা নিজেই কাজ করেন। কোন ধরনের টিম ওয়ার্ক নেই এ সংস্থাটির। ফলে তদন্ত কাজে নেমে একাই সব দিক সামাল দিতে হয় তদন্ত কর্মকর্তাকে।