
কাদের গনি চৌধুরীঃ
বহুল আলোচিত নিপীড়নমূলক আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭সহ ৫টি ধারা বিলুপ্ত করে সোমবার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’র খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। নিবর্তনমুলক এই আইনটি পাস হওয়ার পর দেশ বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার সন্মুখিন হতে হয় সরকারকে। এই আইন হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হন সাংবাদিকরা। অনেক সাংবাদিককে ৫৭ ধারায় কারারুদ্ধ করা হয়।এর ফলে এই আইনের ৫৭ধারা বাতিলের দাবিতে সব মত পথের সাংবাদিকরা রাস্তায় নামে। এক পর্যায়ে সরকারের তরফ থেকে ৫৭ধারা বাতিলের ঘোষণা দেয়। সরকার ৫৭ ধারা বাতিল করেছে বটে কিন্তু বিলুপ্ত করা আইসিটি অ্যাক্টের সেই বিতর্কিত ধারাগুলো আবারো প্রস্তাবিত নতুন আইনে বিভিন্নভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ৫৭ ধারার চেয়েও কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া আইনের খসড়ায় কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ সংক্রান্ত ৩২ ধারার মাধ্যমে সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছে।
নিপীড়ন মূলক আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিল করে এরচেয়েও জঘন্য আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করে সরকার সাংবাদিক সমাজের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে।
আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ধারা কালো আইন হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ “কালোর চেয়েও কালো” আইন। এই আইন পাস হলে মানুষের বাক স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না।
এই আইনে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে হয়রানির আশংকা প্রবল। যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এই আইন মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য হুমকি, মুক্ত চিন্তার জন্য বড় বাধা, স্বাধীন মতপ্রকাশের অন্তরায় এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র।
এই আইন কার্যকর হলে স্বাধীন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়বে। এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করবে। এআইন মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করবে এবং এর ফলে আমাদের ইতিহাসের ওপর গবেষণা সীমিত করবে। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে,সরকার মিডিয়াকে কব্জা করতে অসৎ উদ্দেশ্যে এই আইন করছে। সাংবাদিকদের হাত-পা বাঁধার জন্য এই আইনই যথেষ্ট।
এই আইন পাস হলে সাংবাদিকরা তথ্য পাবে না, আর তথ্য পেলেও মামলার ভয়ে তা প্রকাশ করতে পারবে না । যার কারণে দেশবাসী প্রকৃত সংবাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা মনে করি প্রস্তাবিত এই আইন দেশ এবং জাতিকে গভীর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে। আইনের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অন্যায়কারী এবং স্বার্থন্বেষী মহল নিজেদের হীন স্বার্থে আর সুবিধা আদায় করবে। মানহানির অজুহাতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করে অবাধ তথ্য প্রবাহের ধারাকে বাধা গ্রস্থ করবে। আর এই আইন এদের হাতে সে অস্ত্র তুলে দেবে। সাংবাদিকদের গতিবিধির ওপর এই আইন প্রছন্ন নিয়ন্ত্রণ যা স্বাধীন মতপ্রকাশের অন্তরায়।

অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ’ সংক্রান্ত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর এই অপরাধ যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার করেন বা বারবার করেন তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
এই ধারা দেখেই বুঝা যায়, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৫৭ ধারার চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এটি পাস হলে অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা গুরুতর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে।এরফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ভীষণভাবে কমে যাবে।অন্যদিকে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর স্বেচ্ছাচারীতা ও বে আইনি কাজের সুযোগ বেড়ে যাবে। মন্ত্রী, এমপিদের দুর্নীতির খবর ছাপানোর সাহস কেউ পাবেনা। গোপনসূত্রে পাওয়া রিপোর্ট আর ছাপা যাবেনা।
মোর্দা কথা হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যাঁতাকলে অনুসন্ধানী ও সাহসী সাংবাদিকতা প্রাণ হারাবে।
গণমাধ্যম বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খবর প্রকাশ করে থাকে। আর এক্ষেত্রে সূত্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তথ্যসূত্র গোপন রাখে। কিন্তু আইন বলছে গোপনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না। কেউ সরকারি অফিস থেকে গোপনে কোনো তথ্য সংগ্রহ করলে তার জন্য সাজা পেতে হবে।
পৃথিবীব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি বড় উপাদান হলো সূত্র প্রকাশ না করা। গণমাধ্যম কোন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেটি জানাতে বাধ্য নয়। সংশ্লিষ্টদের দেখার বিষয়, তথ্যটি ঠিক আছে কি না। সাংবাদিক কোথা থেকে এই তথ্য পেলেন, তা জানতে চাওয়া সাংবাদিকতার স্বাধীনতার পরিপন্থী।
২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছিল, বর্তমান আইন তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেই আইনের উদ্দেশ্য ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৩২ ধারা এই অধিকার খর্ব করবে। আইনটি যেভাবে করা হয়েছে, তাতে কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছবি প্রকাশ করলেও এই আইনে মামলা করা যাবে।
তাছাড়া আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হলেও প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় হয়রানির শিকার হবেন সাংবাদিকরা। এ ধারার আওতায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে নতুন করে নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হতে হবে।এই আইন বাকস্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করবে।গণতন্ত্রকামীরা ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।
এ বিষয়ে সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, আইনটি সংসদে পাস করার আগে বিস্তারিত আলোচনার দরকার আছে। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে আইনটি সংসদে পাস করা উচিত। অন্যদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ আইনে বাকস্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। ফিরে যাওয়া হয়েছে মধ্যযুগে। ইতোমধ্যে সাংবাদিকরা এই আইনকে ড্রাকুলিয়ান ল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারাটিই ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা হিসেবে ফিরে এলো কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘না’। এ আইনে কোথাও কোনো ধারায় সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়নি। ‘যে কোনো ব্যক্তির’ আওতায় গণমাধ্যমকর্মীরা পড়েন কিনা- জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।উনার এ নীরবতা আমাদের আরো বেশি শঙ্কিত করে তোলে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে। ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখায় তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে। খসড়া আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এতে কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে তাহলে তাকে ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনের ২৯ ধারায় মানহানির শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যা আগে ছিল আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায়। ওই আইনে শাস্তি ছিল ১৪ বছর এবং ধারাটি ছিল জামিন অযোগ্য। কিন্তু নতুন আইনে সাজা কমানো হয়েছে এবং ধারাটি জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে তাকে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
প্রস্তাবিত আইনের ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, না জানিয়ে কোনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করলে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড বিধান রাখা হয়েছে। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
নিপীড়নের দিক থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৫৭ ধারাকেও ছাড়িয়ে যাবে। এই আইনে নিপীড়নের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা সভ্য সমাজে চিন্তাই করা যায়না।এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আরো সংকুচিত করবে৷
কুখ্যাত এই আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাতকরে, তাহলে তার ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হবে৷
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে৷
এই আইনের আওতায় কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের ‘প্রোপাগান্ডা’ চালান, তাহলেও ১৪ বছরের জেল বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷ এই আইন পাস হলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা বলা বা গবেষণা করা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী শেখ মুজিব সরকারের কৃতকর্ম নিয়েও কিছু বলা যাবেনা। অর্থাৎ আওয়ামীলীগ বা সরকার যা বলবে সেটিই হবে ইতিহাস।অন্য কারো কথা বলার অধিকার থাকবেনা। শেখ মুজিব সরকারের ভুল-ত্রুটি নিয়ে কথা বললে, গবেষণা করলে বা লিখলে তাকে দন্ড ভোগ করতে হবে।
মোর্দা কথা হচ্ছে সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা বা এবিষয়ে কেউ মতামত দিলে তিনি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্থ হবেন।
এই আইনের মাধ্যমে প্রকারান্তরে সরকার ও আওয়ামীলীগের সমালোচনার সকল পথ আইন করে বন্ধ করে দেয়া হলো।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নতুন ডিজিটাল নিরপত্তা আইন তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাকেও ছাড়িয়ে গেছে৷ ঐ আইন বাতিল করে এবার যা করা হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে৷ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে এবং সাংবাদিকদের তথ্য-সংগ্রহ আরো কঠিন হয়ে পড়বে৷”
তিনি বলেন, ‘‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, ছবি তোলা, ভিডিও করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ এখানে বেআইনি শব্দটি ব্যবহার করে সাংবাদিকদের তথ্য-সংগ্রহ এবং ফটো বা ভিডিও-চিত্র ধারণকে বন্ধ করাই উদ্দেশ্য৷ এ ধরনের কাজকে গুপ্তচর বৃত্তি বা রাষ্ট্রদ্রোহ বলে তথ্য-সংগ্রহের কাজটি আরো কঠিন করে ফেলা হলো৷ এটা সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকি৷”
নূর খান বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ বা সংবাদমাধ্যমে নানা শ্রেণির মানুষ এখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন, আলোচনা করেন৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা, মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ব্যাখ্যা কী? এতে করে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকবে এবং মুক্ত আলোচনা বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে আলোচনা করতে আর সাহস পাবে না৷
বেআইনিভাবে কাড়ো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে তাকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে৷ এছাড়া বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি কেউ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে৷
কেউ যদি বেআইনিভাবে কারও ডিভাইসে প্রবেশ করেন, তাহলে এক বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে৷ কেউ যদি কারও ডিভাইসে প্রবেশে সহায়তা করেন, তাহলে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয় দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন, তাহলে তিনি ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখান, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে৷
৩০ ধারায় বলা হয়েছে, না জানিয়ে কেউ যদি কোনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করেন, তাহলে তাকে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে৷
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে তাকে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া হতে পারে৷
এই আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারার সব অপরাধ জামিন অযোগ্য৷ তবে ২০, ২৫, ২৯ এবং ৪৮ ধারার সব অপরাধ জামিনযোগ্য৷
ডিজিটাল আইনের খসড়া তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যা প্রস্তাব করেছি, তা রাখা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে৷ এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে নতুন ডিজিটাল আইনে বিতর্কিত তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নতুন আইনের ১৮ এবং ১৯ ধারায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, ৩২ ধরায় যে বিধান রাখা হয়েছে তাতে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র এবং স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে৷”
তার কথায়, ‘‘বিনা অনুমতিতে অফিসে ঢুকে কেউ যদি তথ্য নেন, সেজন্য অন্য আইন আছে৷ কেউ যদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা ফাইল পাচার করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন, তার জন্য ‘অফিসিয়িাল সিক্রেট অ্যাক্ট’ আছে৷ কিন্তু নতুন আইনে আবার তা ঢোকানো হয়েছে৷ কোনো সাংবাদিক ‘স্টিং অপারেশন’ কেন চালায়? ঘুস বা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করতে৷ এই আইনের ফলে তা আর পারা যাবে না৷ অন্যদিকে সাধারণ মানুষ যদি কোনো সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঘুস দিতে বাধ্য হন আর তা যদি তিনি তার মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে আনেন, তবে তা প্রকাশ করতে পারবেন না৷ অর্থাৎ ঘুষ খেলেও তার তথ্য প্রকাশ করা যাবে না৷ তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? আমার মতে, এটা সুশাসনের পথে বাধা৷ সাংবাদিকতা সত্যিই এবার অসুবিধার মুখে পড়বেন৷”
এদিকে প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল যুগান্তরকে বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বা গুপ্তচরবৃত্তি করে কোনো অপরাধ করলে তাদের জন্য ধারাটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু আইনটি গণমাধ্যম কর্মীদের ক্ষেত্রে কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আইনটি সংসদে পাস করার আগে সাংবাদিক প্রতিনিধি, শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীদের মতামত নেয়া উচিত। সুনির্দিষ্ট করতে হবে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগটি কার জন্য করা হয়েছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ৫৭ ধারাকে ভেঙে চারটি ধারা করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের বাকস্বাধীনতাকে অপরাধে পরিণত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কোনো রিরূপ মন্তব্য করা যাবে না, প্রশ্ন করা যাবে না, সমালোচনা করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড হবে। এসব আইন শুনে খুব দুঃখ লাগে। আমেরিকার সংবিধানে ১৭৯১ সালে তারা বলেছিল, সংসদ বাকস্বাধীনতা খর্ব করে কোনো আইন পাস করতে পারবে না। ওটা হল গণতন্ত্র। এটা পনের’শ, ষোল’শ এবং সতের’শ সালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিতে বড় বড় রাজা করতেন। তারা তখন আইন করতেন রাজার ব্যাপারে, তাদের পুত্র, কন্যা, তাদের ড্রেস ও মুকুটের ব্যাপারে- কোনো বিরূপ মন্তব্য করলে শূরে চড়ানো হবে। হাজার হাজার লোককে মধ্যযুগে শূরে চরানো হয়েছে। মধ্যযুগ আর গণতন্ত্রের পার্থক্য হল- গণতন্ত্রে সবাই কথা বলতে পারবে। আমরা সোয়া দুইশ’ বছর আগের আমেরিকাকে অতটা গণতান্ত্রিক না বলি, কিন্তু এখন এতকিছুতে কথা বলা যাবে না। আমি তো বলব, এটা মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার আইন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন,”ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এ ৫৭ ধারাকে ঘুরিয়ে উপস্থাপন করার আশঙ্কা শুরু থেকেই ছিল। সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এই ধারার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাংবাদিকরা। এই আইন কোনোভাবেই যৌক্তিক না। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি আরও বলেন, কারও দুর্নীতি, অন্যায় তুলে ধরলেই মানহানি হয়েছে উল্লেখ করে মামলা ঠুঁকে দেওয়া হয়েছে ৫৭ ধারায়। নতুন এই খসড়াতেও এসব বিধান বহাল আছে। এটা হলো ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’। দেশের মানুষকে বোকা ভেবে একটা বিষয়কে ঘুরিয়ে খাওয়াচ্ছে।”
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন -বিএফইউজের মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ এ আইনকে ‘ভয়ঙ্কর ও নিবর্তনমূলক’ উল্লেখ করে বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে দেশের সাংবাদিক সমাজ দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত শতাধিক সাংবাদিককে এ কালো আইনে গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়েছে। সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিবাদের মুখে সরকার ৫৭ ধারা বাতিলের ঘোষণা দেয়। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি যে, ৫৭ ধারা বিলুপ্তির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে ওই ধারার বিষয়গুলোকে ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১- এ ৪টি ধারায় বিভক্ত করে নতুনরূপে সংযোজন করা হয়েছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। একই সঙ্গে অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করতে নতুন করে ভয়ঙ্কর ৩২ ধারা যুক্ত করে কথিত গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে’।
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওয়েবসাইট বা ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য যেমন বিধান রাখা হয়েছে, তেমনি মানহানি, আইন-শৃঙ্খলা অবনতির শঙ্কা, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মত বিষয়ে কঠোর দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি আক্রমনাত্মক ও ভীতি প্রদর্শন করার মত বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে জেল ও উচ্চ হারে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংবাদমাধ্যমবিরোধী সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিধান সংযোজিত হয়েছে ৩২ ধারায়। এতে সরকারি অফিসে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ ও কোন নথির ছবি তোলাকে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ১৪ বছরের কারাদন্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এখানে ‘বেআইনীভাবে প্রবেশ’ বা ‘গোপন নথি’র বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্ত তার আগেই কোন সংবাদকর্মীকে গ্রেফতার ও হয়রানি করা যাবে। এ ধারার ফলে দুর্নীতি, লুটপাট ও অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পথই শুধু রুদ্ধ হবে না অনুসন্ধানী বা সত্যিকারের সাংবাদিকতাই আর চলবে না। ফলে গোটা সাংবাদিক সমাজ উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। এ বিধান দেশে দুর্নীতিকে অবারিত ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে। বিপন্ন করবে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর সাংবাদিকতাকে’।
প্রতিটি মানুষ জন্মসূত্রে কিছু অধিকার পেয়ে থাকেন।যা তার মৌলিক অধিকার। বাকস্বাধীনতা মৌলিক অধিকার গুলোর অন্যতম।ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে সরকার মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।
এই আইনে নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এ আইন সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক। কারণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। এই আইনের মাধ্যমে সে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।কেড়ে নেয়া হয়েছে লেখা ও বলার স্বাধীনতা। সাংবাদিকদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্বাধীন সাংবাদিকতার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে।
অবাধ মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। কোনো ভাবেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত একটিদেশের নাগরিকের মতপ্রকাশের ওপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা মানেই সেদেশের গণতন্ত্র চর্চায় ব্যঘাত ঘটানো, যা কাম্য হতে পারে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।”