
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পাকিস্তানের এমভি সোয়াত নামে একটি জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। পাকিস্তানি সেনারা সেই জাহাজের অস্ত্র খালাসের উদ্যোগ নিলে বন্দরের শ্রমিকরা বুঝে যান, সেগুলো চালানো হবে বাঙালির বুকে। বাংলার মেহনতি শ্রমিকরা অস্ত্র খালাসে অপারগতা জানালে পাকি সেনারা তাদের বুকেই গুলি চালিয়ে দেয়।
কুখ্যাত সোয়াত জাহাজে করে অস্ত্র আসার খবর মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের সর্বস্তরে। দাবানলের মতো জ্বলে উঠে মুক্তিকামী বাঙালি। অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের ডাক আসে। প্রতিরোধ করতে গিয়ে আবারও পাকি সেনাদের গুলির মুখে পড়েন প্রতিবাদী জনতা। অকাতরে বিলিয়ে দেন নিয নিয প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরুর আগেই ২৪শে মার্চ সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের সেই দিনটি আসলে ৯ মাস ব্যাপী বাঙালির জনযুদ্ধ-র শুরু।
যুদ্ধ বলতে যেটা বুঝায় সেটা কিন্তু চট্টগ্রামে শুরু হয়েছিল ৩ মার্চ, ১৯৭১-এ ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে। ২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের জন্য যে রক্তস্নাত আন্দোলন হয়েছিল সেটা জনযুদ্ধে আরো ব্যাপকতা দেয়। কারণ সেই আন্দোলনে শ্রমিক, ছাত্র, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাধারণ জনতা সবাই ছিলেন। আর চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই।
সেদিন ক্যাপ্টেন রফিক হালিশহরে ইপিআরের ক্যাম্প দখল করে প্রায় ১৫০ জন অবাঙালি সৈন্য হত্যা করেন। সোয়াত জাহাজে অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানালে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকদের উপর চড়াও হয় পাকিস্তানি সেনারা। বিভিন্নভাবে চাপ দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে প্রায় ১৫০ শ্রমিককে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে খুন করা হয়। এই ঘটনার পর শ্রমিকরাও সেই সময় চলা উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনে পূর্নমাত্রায় যোগ দেয়। যে কোন জনযুদ্ধের জন্য এই ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে একটা বড় ঘটনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে সত্যিকারের জনযুদ্ধ ছিল এটাই তার অন্যতম বড় প্রমাণ।
বন্দরের এক ক্ষুব্ধ ডক শ্রমিক সোয়াত জাহাজ থেকে ২৪শে মার্চ অস্ত্র খালাস হবে বলে এমন তথ্য পৌঁছে দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নানের কাছে। তিনি বিষয়টি ঢাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের জানালে, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা আসে, কোনভাবেই সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে দেয়া যাবে না এবং জাহাজের পাকিস্তানী সৈন্যদেরও নামতে দেয়া যাবে না। চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরী, মজিদ মিয়া, ইসহাক মিয়া, আতাউর রহমান খান কায়সার, আবদুল্লাহ আল হারুন, আবু সালেহ, এস এম জামালউদ্দিন, মোহাম্মদ হারিছ মিয়া সভা-সমাবেশে সোয়াত জাহাজে করে অস্ত্র আনার বিষয়টি তুলে ধরে জনতাকে প্রতিরোধের আহ্বান জানান। ২৪শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে, বিকেল ৪টায় সোয়াত জাহাজ অবরোধের ডাক দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কলোনির মাঠে সমাবেশ ডাকা হয়।
সেদিন সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের সমাবেশ আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা শামসুদ্দিন, চট্টগ্রাম বন্দরের জুনিয়র ক্লার্ক আ ক ম রইসুল হক বাহার, তরুণ ছাত্র আব্দুস সাত্তার ও তারেক। সেই সমাবেশে শুধু ছাত্র-তরুণই নয়, বন্দরের শ্রমিক এবং নিউমুরিং কলোনিসহ আশপাশের এলাকার সাধারণ বাসিন্দারাও যোগ দেন। বিশাল সমাবেশ এক পর্যায়ে প্রতিবাদি জনসভায় রূপ নেয়।
সন্ধ্যার দিকে সমাবেশস্থলে খবর আসে অস্ত্র খালাসের জন্য সোয়াত জাহাজ জেটিতে ভিড়েছে। সমাবেশ থেকে ৪-৫ হাজার মানুষ স্টিলের রড নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নম্বর জেটি অভিমুখে মিছিল শুরু করে। চকবাজারের প্যারেড গ্রাউন্ডে সেদিন মঞ্চস্থ হচ্ছিল নাটক ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাদের কাছে খবর পৌঁছার পর জনতা নাটক দেখা বন্ধ করে বন্দরের দিকে রওনা দেয়। বন্দর থেকে ডক শ্রমিকরাও বেরিয়ে আসে।
আগ্রাবাদের বারেক বিল্ডিং মোড়ে নেভি ফিট ক্লাবে ছিল বন্দর জোনের নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সেন্টার। নেভি ফিট ক্লাব ঘেরাও করে রাখাও ছিল সেই মিছিলের অন্যতম উদ্দেশ্য। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে মিছিল যখন বন্দরের তিন নম্বর জেটি গেটের কাছে পৌঁছে, তখন পাকবাহিনী রাস্তা অবরোধ করে গুলি চালায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গভীর রাত ১টা পর্যন্ত সেদিন ওই এলাকায় গুলির শব্দ শোনেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেকেই শহীদ হন। সঠিক সংখ্যা সেভাবে জানা যায়নি। তবে, কমপক্ষে ০৩ থেকে সর্বোচ্চ ২৩ জন শহীদের তথ্য পাওয়া যায়।
১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতে কিছু অস্ত্র খালাস করা হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে সোয়াত জাহাজের সব অস্ত্রই খালাস করা হয়। ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরুর পর ট্রেনে করে সেই অস্ত্র তার গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এমভি সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ, যুদ্ধ শুরুর আগেই বাঙালিদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি বড় আকারের চ্যালেঞ্জ ছিল। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা মানুষের মাঝে প্রবল জাগরণ সৃষ্টি করেছিল।
সূত্রঃ ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থ।