
কামরুল ইসলাম দুলু,ভারতের ভেলোর থেকেঃ
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে ”ভুল চিকিৎসা” কথাটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রতিদিনই সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। যার ফলে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত মানুষ ভারতের বিভিন্ন হাসপাতলে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে।দেশের হাসপাতালে রোগীকে বলে দেওয়া হলো আপনার দু’টি কিডনীই ড্যামেজ হয়ে গেছে! হতাশায় রোগীর স্বজনরা ছুটে গেলো ভারতে। সেখানে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে বুঝলেন কিডনী টিকই আছে। সামান্য ঔষধ লিখে দিলেন। খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন রোগী। এধরনের ঘটনার কথাও শুনা যায় মাঝে মাঝে।
গত ২৯ জুন চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদি বাগের ম্যাক্স হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশু রাইফার জীবন অকালেই ঝরে যায়। এঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। এধরনের ভুল চিকিৎসা প্রতিনিয়ত ঘটছে।
দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি ফারুক আবদুল্লাহ মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছয়মাস চিকিৎসার পরও সুস্থ হয়নি! তার ডান পায়ে অপারেশন হয়। অপারেশনের পর তার পা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকে! ডাক্তাররা বলে দিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে। তার পায়ের সঠিক চিকিৎসা হয়নি। ভারতের সিএমসি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন সে, সেখানকার ডাক্তাররা বললেন তার পায়ে ভুল চিকিৎসা হয়েছে।
হাফিজ জুট মিলস সিবিএ সাবেক সেক্রেটারী কামাল উদ্দিন তিনি তার ছেলেকে নিয়ে গেলেন ভারতের সিএমসি হাসপাতালে। চমেক হাসপাতালে তার ছেলে ভুল চিকিৎসার শিকার।
সিএমসি হাসপাতালে দেখা সীতাকুণ্ডের যুবক আশরাফ উদ্দিন মিন্টু জানালেন, আমার স্ত্রীর পেটে টিউমার আছে বলে বেসরকারী সিএসসিআর হাসপাতালে অপারেশন করলেন, অপারেশনের পর এক্সেরের রির্পোটে দেখা গেলো আরো একটি টিউমার পেটে রয়ে গেছে, অথচ ডাক্তাররা তা জানতে পারেননি। আমাদের দেশের ডাক্তারদের প্রতি আস্থা না থাকাতে আমাকে ভারতে আসতে হয়েছে। অথচ এখানে এসে অল্প টাকাতে চিকিৎসা করিয়ে এবং ডাক্তারদের সুন্দর ব্যবহারে আমার স্ত্রী এখন সুস্থ।

চিকিৎসা একটি মানবিক পেশা। এই পেশার গুরুত্ব লিখলে যেমন সমাপ্তি টানা যাবে না তেমনি অসংগতির কথা লিখলেও শেষ হবে না। মানুষ বিপদে পড়লে সাধারণত পুলিশ, আইনজীবী এবং ডাক্তারের কাছেই ছুটে যায়। কিন্তু এই তিনটি পেশা যখন অসাধু ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তখনই সমাজ ও রাষ্ট্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের ভোগান্তি বেড়ে যায়। ডাক্তাররা আমাদের মতোই মানুষ। ভুল হবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে একশ্রেণির চিকিৎসকদের মধ্যে সেবার মনোভাব শূন্যের কোঠায়। তারা রোগীর জীবন বাঁচানোর চেয়ে নিজেদের পকেট ভারি করার কাজে সদা ব্যস্ত। আমাদের দেশে স্বনামধন্য অনেক চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু ভালো মানের চিকিৎসা সেবার সুযোগ থাকলেও ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পাশের দেশে চলে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন তিনটি রুটে (বিমান, রেল ও বাস) প্রায় ৮ হাজার লোক ভারতে চিকিৎসা ও ভ্রমণে যায়। আর এজন্য ভিসা আবেদন বাবদ জনপ্রতি ৬শ টাকা করে জমা দিতে হয়। এতে প্রায় প্রতিদিন ঢাকার তিনটি ভিসা কেন্দ্র (গুলশান, শ্যামলী ও উত্তরা) সহ প্রায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাগুলোর ভিসা কেন্দ্রের সহযোগিতায় ৪৮ লাখ টাকা পাচার হচ্ছে, এতে মাসে পাচার হচ্ছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, বছরে প্রায় ২শ কোটি টাকা। আর বিভিন্ন অযুহাতে যাদের ভিসা আবেদন বাতিল করা হচ্ছে তাদের জমা ৬শ টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। হিসাব না থাকলেও তাদের সংখ্যাও কম নয়।
জানা গেছে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্তরাই ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তদের বেশি দেখা যাচ্ছে। ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতি রুগী ন্যুনতম ৩ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। সে হিসেবে ন্যূনতম চিকিৎসা ব্যয় হচ্ছে প্রতিদিন ২শ ৪০ কোটি টাকা, মাসে ৭ হাজার ২শ কোটি টাকা আর বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা। যাদের চিকিৎসা খরচ বেশি হচ্ছে সেই হিসেব করলে টাকার পরিমাণ কোথায় দাঁড়াবে? তবে দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছেই। কেন ভারতমুখি হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় চিকিৎসকদের প্রতি আস্থাহীনতাই এর জন্য দায়ী। কারণ এদেশীয় চিকিৎসকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রুগীদের নিয়ে গোঁজামিলের আশ্রয় নেয়ার এবং সেবার পরিবর্তে ব্যবসা করছে বলে রুগীদের অভিযোগ। বাস্তবে রুগীদের অভিযোগের সত্যতার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এতে কোটি কোটি দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ভারতের ভেলোর এ চিকিৎসা নিতে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা বহু রোগীর সাথে আলাপে জানতে পারলাম, বেশিরভাগ রোগী ভুল চিকিৎসার স্বীকার হয়ে এখানে এসেছে। যেখানে আমাদের দেশের একটি রোগের এক্সরের রির্পোট একেক ক্লিনিকে এক এক রকম হয় সেখানে ভারতের সিএমসি হাসপাতালের রির্পোটে ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। এই হাসপাতালের এক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে তিনি জানালেন, সিএমসি হাসপাতালের সাধারণ একজন দারোয়ান থেকে শুরু করে ডাক্তার-নার্সসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ভুল চিকিৎসার রির্পোট বা ভুল চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই এখানে। যার ফলে সিএমসি হাসপাতাল বিশ্বে চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি মডেল।