
যুব সমাজ ধ্বংসের মাদক ইয়াবা বড়ি ব্যবসার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিল সাইফুল করিম।
দেশের লাখো তরুণ-তরুণী ইয়াবার ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে সাইফুলের ভূমিকা রয়েছে। গেল ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারে ১০২ মাদক ব্যবসায়ীকে আত্মসমর্পণ করাতে যে মাধ্যমটি ভূমিকা রেখেছিল, সেই মাধ্যমেই তিনি আত্মসমর্পণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে পুলিশের একটি সূত্র।
১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ইয়াবার চালান ঢোকে। সেই চালানটি এনেছিলেন সাইফুল। বিভিন্ন আসামির জবানবন্দি ও নানা তথ্য ঘেঁটে পুলিশ এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে।
২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ১৫১ মাদক জন ব্যবসায়ীর তালিকায় প্রথম নামটি ছিল এই সাইফুলের। এবারের ঈদের পর কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল।

স্থানীয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুল করিম ইয়াবা ব্যবসার আড়ালে রাতারাতি ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি কক্সবাজার জেলায় সর্বোচ্চ কর দিয়ে লাভ করেন সিআইপি মর্যাদা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তির সঙ্গেও তার সখ্যতা ছিল। গেল বছরের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রামে একসঙ্গে ১৩ লাখ ইয়াবা বড়ির একটি চালান জব্দ হওয়ার পর আলোচনায় আসেন সাইফুল। এরপর তিনি আড়ালে চলে যান।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, সাইফুল দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। কক্সবাজারের ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আত্মসমর্পণ করাতে স্থানীয় যে মাধ্যমটি ভূমিকা রেখেছিল তারা সাইফুলকে আত্মসমর্পণ করানোর নেপথ্যে কাজ করছে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, এমন খবর আমরাও পেয়েছি। ইয়াবা ব্যবসার একজন মূল হোতা আত্মসমর্পণ করতে চান, সঙ্গে আরও কয়েকজন। এটি (আত্মসমর্পণ) চলমান বিষয়। যে কেউ শর্ত সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে। তবে আইনের নিজস্ব গতি রয়েছে, আইন সে অনুযায়ীই চলবে।

তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজারের অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। তবে ইয়াবার মূল হোতাদের কেউ কেউ ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশকে মাদকমুক্ত করতে হলে তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে। আমরা স্বাগত জানাব, যদি তারা আত্মসমর্পণ করতে চায়।
১৩ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দের পর কক্সবাজার ও মিয়ানমারের মূল চোরাকারবারিদের তালিকা পায় প্রশাসন। সাইফুল করিম তাদেরই একজন। ১৩ লাখ ইয়াবা পাচারে জড়িত মো. আশরাফ আলী ও রশিদ ওরফে মুন্না চট্টগ্রামের আদালতে মিয়ানমারের চোরাকারবারি আবদুর রহিম ও সাইফুল করিমকে দায়ী করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের স্বীকারোক্তিতে ওঠে আসে ১৮ কোটি টাকার লেনদেন। চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে কাউন্টার টেররিজমে দায়িত্বরত।
শহীদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবার ইয়াবা বড়ির চালান আসে ১৯৯৭ সালে। সাইফুল করিম চালানটি এনেছিলেন। একসঙ্গে ১৩ লাখ ইয়াবা জব্দের পর সাইফুলের ব্যাপারে এসব তথ্য পাওয়া যায়। মিয়ানমারের রহিম ও সাইফুলকে ধরা গেলে দেশে ইয়াবা বড়ি পাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। সাইফুল আমাদের মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অন্যদের সঙ্গে হাজি সাইফুলেরও থাকার কথা ছিল। তবে নিজেকে সমর্পণ না করে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। এর পর থেকে তিনি ইয়াঙ্গুন ও দুবাইয়ে অবস্থান করতেন। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর গত ২৫ মে দেশে ফেরেন হাজি সাইফুল। পরিবারের চাপে তিনি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন।
কে এই সাইফুল করিম :
কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার শীলবুনিয়াপাড়ার চিকিৎসক মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাইফুল করিম। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ইয়াবা ডিলারদের কাছে তিনি ‘এস কে’ নামে পরিচিত। একসময় পারিবারিকভাবে তেমন অর্থবিত্ত ছিল না সাইফুলের পরিবারের। বাবার পল্লী চিকিৎসা ও ফার্মেসিই ছিল পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। তবে ২০০৮ সালের পর হঠাৎই অবস্থার পরিবর্তন হয়। এ সময় ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েন হাজি সাইফুল করিম। হয়ে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। চট্টগ্রামে কয়েকটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, কক্সবাজারে আবাসিক হোটেলসহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ আছে তাঁর।
জানাগেছে-গত ৩ মে শুক্রবার রাতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে হাজি সাইফুল করিমের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সাইফুলের দুই ভাই রাশেদুল করিম ও মাহবুবুল করিমকে আটক করে পুলিশ। তাঁরা দুজন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পারিবারিক ইয়াবা কারবার আড়াল করতেন বলে জানা গেছে। তাঁদের আরেক ভাই সাংবাদিক জেড করিম জিয়াও তাঁদের পারিবারিক ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্য। সাইফুলের ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ মনির টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র। তিনিও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সাইফুল পরিবারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
				
								
								
								