ফন্ট সাইজ

শেয়ার করুন

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print

পত্রিকাখোর সাদা মনের শুদ্ধ মানুষ একজন বাবুর বাবা!

সংবাদটি পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সালেহ বিপ্লব

আজকের কাগজ। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) কাজী শাহেদ আহমেদ কিংবা নাঈমুল ইসলাম খান জানেন কি না বিষয়টি, বাবু নিজের মধ্যেই এ নিয়ে সংশয়ে ভুগতো। সেই ১৯৯১ সাল থেকে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলো বাবু। একজন সাদা মনের শুদ্ধ মানুষ আজকের কাগজকে কী পরিমাণ যে ভালোবাসতেন, সেটা ‘স্যার’ বা নাঈম ভাই জানেন কি না, এই ছিলো তার সংশয়ের ভিত্তি। রাজনৈতিক পরিবার, সেই খুব ভালো মানুষটির বড়ো ভাই এমপি ছিলেন। পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। পুরো বাড়িতে সংবাদপত্র আর বইয়ের বাগান যেনো!

নারী-পুরুষ, ছোটো-বড়ো সবাই পড়ে। সংবাদ, বাংলার বাণী, খবর, অবজারভার আর ইত্তেফাক। একতা। চিত্রালী, পূর্বাণী, বিচিত্রা, বেগম। কিশোর বাংলা, শিশু, ধানশালিকের দেশ। যে শুদ্ধাচারী মানুষটির কথা বলছি, তিনি পত্রিকার পাঠক ছিলেন; এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না আসলে। পত্রিকার হকার ‘আমীর হোসেন’ কেনো এখনো আসছেন না, কেনো দেরি হচ্ছে; এই নিয়ে তিনি স্ত্রীকে তো বটেই, সন্তানদেরও দায়ী মনে করতেন। পত্রিকা হাতে না আসা পর্যন্ত মেজাজটা চড়া থাকতো তার, দেরি সহ্য করতেই পারতেন না। যে সময়ের কথা বলছি, তখন রেলওয়ের অফিস টাইম ছিলো ভোর সাড়ে সাতটা থেকে বেলা আড়াইটা। ঢাকার দৈনিক পত্রিকা আসতো তিনটার দিকে। তিনি অফিস থেকে এসে গোসল-খাওয়া সারতে সারতে পত্রিকা এসে যায়। এক ঘণ্টা পত্রিকার মধ্যে ডুবে থাকতেন, এরপর কিছুক্ষণ ঘুম। তার রুটিন। কখনো কখনো পত্রিকা পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। সে সব দিনে বাচ্চারা বাপের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাই জীবনের প্রধানতম কর্তব্য বলে মেনে নিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তার প্রতিপালন করতো।

আর তখনকার দিনের পত্রিকা তো এখনকার মতো ছিলো না। পত্রিকার মাস্টহেডের নিচে তারিখ থাকতো দুইটা। ঢাকা ১৬ জুন, মফস্বল ১৭ জুন। তখন মেঘনা গোমতী সেতু ছিলো না। চট্টগ্রামের পাঠক ঢাকার পত্রিকা দুপুরের পরেই পেতেন। তো সেই মাটির মানুষটি পত্রিকার ভেতর এভাবে ডুবে যেতেন, স্পষ্ট বোঝা যেতো, কাঙাল হরিনাথ এই বাংলায় অন্তত কিছু মানুষকে খবরের নেশা ধরিয়ে দিতে পেরেছেন। কালো অক্ষর সাদা করে মানুষের ভেতরটা, পত্রিকাখোর সেই নিপাট ভদ্রলোককে দেখে এমন একটা ধারণা যে কারো মনে আসতে পারতো। এবং আসতো অবশ্যই। খবরের নেশায় বুঁদ সেই মানুষটি আজকের কাগজকে খুব খুব ভালোবাসতেন। অন্যদের বলতেন, ‘আরে কী পড়েন? অনেক বছর তো পড়লেন, আমিও পড়লাম। আজকের কাগজ পড়েন। সপ্তম পৃষ্ঠার অষ্টম কলামে যাওয়ার ঝামেলা শেষ। এডিটরিয়াল পাতা দেখেন। কতোগুলো আর্টিকেল। বিষয়গুলো দেখেন, লেখকদের দেখেন।’

আজকের কাগজের এমন আন্তরিক প্রচার করছেন একজন ভক্তপাঠক, এর চেয়েও বড়ো মাত্রার আবেগঘন ঘটনা ‘স্যার’ কিংবা নাঈম ভাই ভুড়ি ভুড়ি দেখেছেন, সে সময়েই বাবুর এমন ধারণা ছিলো। তবে এটাও অনুভব করা যেতো, পত্রিকার মালিক বা সাংবাদিকরা এমন এক পাঠককে যদি জানতে পারতেন, দেখতে পারতেন; তারা খুশি হতেন। তখন থেকেই মিশুক ও অমায়িক সেই রেলকর্তা বিশিষ্ট চক্ষুবিদ ডা. মোদাচ্ছের আলীর একনিষ্ঠ ভক্ত। সুযোগ পেলেই ওনার কথা বলতেন। বিশেষ করে সমমনা মানুষ পেলে। তবে পত্রিকাসক্ত মানুষটি কখনো ভাবতেও পারেননি, বাবু একদিন দুম করে আজকের কাগজের সাংবাদিক হয়ে যাবে। বাবু তার ছেলে। কোন পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই ছেলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো মুহূর্তের সিদ্ধান্তে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই পত্রিকায় ঢুকে গেলো। দৈনিক রূপালীতে। এরপর আজকের কাগজে। ডিসি এসপি না হয়ে অভাব অনটনের চাকুরিতে ঢুকে ছেলে তার মনে যে কষ্ট দিয়েছিলো, সেটা অনেকটা ফিকে হয়ে এলো আজকের কাগজে চাকুরি হওয়ার খবর শুনে। এর মধ্যে সরকারি চাকুরি থেকে অবসরে গেলেন। চোখের সমস্যা অনেক দিন ধরেই, চট্টগ্রামে লায়ন্স হাসপাতালের চিকিৎসা নিতেন। ছেলে আজকের কাগজে জয়েন করার পর বাবার মনে অনেক খুশি। ঢাকা এলেন। ছেলের মোবাইল নেই তখনো, বাবারও নেই। নয়াপল্টনের জামাতখানায় ভাগ্নের বাসায় যেতে বললেন ছেলেকে। দেখা হওয়ার পর একটাই দাবি। ‘বাজান, আমারে ডা. মোদাচ্ছের আলীর কাছে নিয়া যাইতে পারবা? আমার খ্বু সখ ওনারে একবার কাছ থেকে দেখবো। উনি তো তোমাদের মালিকপক্ষের বন্ধুস্থানীয়, তাই না? পারবা বাজান?’

বাবু আগেই বলে রেখেছিলো তাদের বাদলদাকে। বাদল চন্দ্র সোম। সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদের একান্ত সহকারি। তিনি মোদাচ্ছের স্যারকে ফোন করে জানিয়ে রেখেছিলেন। বাবু তার বাবাকে নিয়ে আছরের নামাজের আগেই সরাসরি ধানমন্ডি, স্যারের চেম্বারে। সিরিয়াল লাগেনি, যাওয়ামাত্রই স্যারের সামনে নিয়ে গেলো তার সহকারি। স্যার বাবুর বাবার চোখ দেখলেন। পরামর্শ দিলেন। এই ফাঁকে সাদা দিলের মানুষটি প্রফেসর সাহেবকে জানিয়ে দিলেন, স্যার আমি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। বঙ্গবন্ধুর জন্য আপনি যে কাজটি করেছেন, সেদিন থেকেই আপনাকে মনে মনে সালাম জানিয়েছি। আজ আপনার স্পর্শ পেয়ে আমার অনেক অনেক ভালো লাগছে। স্যার ভিজিট নিলেন না। একটা দামি ড্রপ দিয়ে দিলেন গিফট হিসেবে। এরপর বাবু তার বাবাকে নিয়ে ৩২ নম্বর গেলো। তারপর নয়াপল্টন পৌঁছে দিতে মিশুক নিলো। মিশুক যখন এখনকার বসুন্ধরা শপিং মল পার হচ্ছে, শুরু হলো বৃষ্টি। পেছন দিক থেকে তির্যক বর্শা হয়ে বৃষ্টি ভেজাতে লাগলো দু’জনকে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাটি বাবুকে নিজের শরীরের আড়াল দিয়ে রক্ষা করছেন, বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিজের পিঠ দিয়ে ছেলেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছেন। বাবু তো বিব্রত। কী করো বাবা? তোমার শরীর খারাপ করবে তো। জবাবে বাবা বললেন, আমার কিছু হবে না। আমি তো বাসায় গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করবো। আর তুই বাবা সেই রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করবি রে বাবা। তোর ঠাণ্ডা লেগে যাবে। জোর করেই এতো বড়ো ছেলেকে বুকে ধরে রেখে বৃষ্টি থেকে প্রায় পুরোটাই সেভ করেছিলেন সেই পত্রিকাপ্রিয় সাদা মনের মানুষটি।

মানুষটি যেদিন মারা গেলেন, তার পরদিন বাদ জোহর তাকে দাফন করা হলো বাবা-মার পাশে। সেপ্টেম্বর মাস, বৃষ্টি ছিলো বেশ। হুটহাট করে চলে আসে। দাফন হলো। দিন ফুরালো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রাত গড়িয়ে অনেক রাত। ঝরঝর করে শুরু হলো বৃষ্টি। বাবুদের বাসার সামনেই মসজিদলাগোয়া পারিবারিক গোরস্তান। বাইরের একটা ঘরের জানালা দিয়ে বাবু একা একা বাবার কবর দেখছিলো। বৃষ্টির কথা ভেবে কবরের ওপর সামিয়ানা টাইপের ভারি কাপড় টানানো। বাবু দেখছে বাবার কবর, দেখছে আচমকা নামা বৃষ্টিকে। বাতাস শুরু হলো। তুমুল বাতাস। সামিয়ানা উড়ে গেলো। বড়ো বড়ো ফোঁটার বৃষ্টি বাবার কবরে পড়ছে। বাবুর মনে হলো, বাবাতো ভিজে যাচ্ছে। মনটা কেমন যেনো করে উঠলো! মনে পড়ে গেলো, এই বাবা নিজের নীল সাফারি আর শরীর ভিজিয়ে পান্থপথে ছেলেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছিলেন। অথচ আজ বাবুর ক্ষমতা নেই সেই বাবাকে ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা করার। বাবা মারা যাওয়ার পর কঠোর নিয়ন্ত্রণে নিজেকে সামলে রেখেছিলো নিজেকে, চোখের জল দেখতে দেয়নি কাউকে। কিন্তু সেই গভীর রাতে বাবু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। মনে হচ্ছিলো, বুকের ভেতর থেকে কলজেটা ছিঁড়ে বের হয়ে আসছে। এমন কষ্ট। কী যে কষ্ট বাবাকে হারানোর!

বাবুর বয়স এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। এখনো দিনরাত নেই, যে কোনো সময় বাবু তার বাবার কথা ভেবে কেঁদে ফেলে। ঘরে হোক বাইরে, এখন আর চোখ শাসন মানে না। দ্রুত চোখ মুছতে গিয়ে আরো বেশি কেঁদে ফেলে। আজও সে বাবার জন্য কাঁদে। বাবুর বাবা আজকের কাগজকে ভালোবাসতেন। কাজী শাহেদ আহমেদকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন নাঈমুল ইসলাম খানকে। কিন্তু বাবু এখন কাজী শাহেদ আহমেদকে দেখার সুযোগ আর পায় না। দূর থেকেই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে প্রিয় স্যারকে। নিয়তি এমনই নিষ্ঠুর! দূরে সরিয়ে দেয় প্রিয় মানুষকে। আবার এই নিয়তি অনেক দয়ালু। অনেক অনেক হৃদয়বান। নিয়তি বাবুকে পৌঁছে দিয়েছে তার বাবার প্রিয় সেই সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের স্বপ্ন-নীড়ে। তাই বাবু আবার স্বপ্ন দেখার চোখ ফিরে পেয়েছে। সেই চোখ এখনো বাবার জন্য কাঁদে।

লেখকঃ সিনিয়র নিউজ এডিটর, আমাদের নতুন সময়।

সর্বশেষ

ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে চট্টগ্রামে বিআরটিএ’র বিশেষ অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা হয়নি: প্রেস সচিব

সিরিয়ার ঋণ শোধ করবে সৌদি-কাতার

ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ

প্রথম চুয়েটের রিফাত আল ইব্রাহিম ⦿কেএসআরএম অ্যাওয়ার্ড পেলেন তিন ভবিষ্যৎ স্থপতি

ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আগ বাড়িয়ে মধ্যস্থতা করতে চায় না বাংলাদেশঃ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সন্ধ্যায় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে প্রথমবারের মতো উড়াল দেবে কার্গো ফ্লাইট

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print