
দেশে ব্যবহৃত প্রায় সব প্রসাধনী সামগ্রীতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমনকী অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সারের কারণও হচ্ছে ওইসব প্রসাধনী।
শনিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন- এসডোর প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত বেশিরভাগ প্রসাধনী সামগ্রীতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে। যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়াবহ। বিশেষ করে বিভিন্ন রং ফর্সাকারী ক্রিম ও বেবিলোশনে উচ্চমাত্রার টাইটেনিয়াম পাওয়া গেছে। যা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।
সরকারের সাবেক সচিব ও এসডোর চেয়ারপারসন সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ, ‘‘প্রসাধনী সামগ্রীতে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য: পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য নতুন ঝুঁকি’’ নামক গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭৮ শতাংশেরও বেশি রং ফর্সাকারী ও ব্লিচিং ক্রিমে পারদ (মার্কারি) এর পরিবর্তে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও টাইটেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। যেগুলোর বেশির ভাগই ত্বক উজ্জ্বল করতে সাধারণ ধাতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিক পদার্থগুলো পারদের থেকেও দ্বিগুণ ক্ষতিকর এবং এসব পদার্থ থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গবেষণায় বলা হয়, রং ফর্সাকারী ক্রিমে গড়ে আর্সেনিক রয়েছে ১৬৩০.০৬পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। একটি জনপ্রিয় বেবিলোশনে ২৪১ পিপিএম টাইটেনিয়াম ও পরীক্ষিত সব বেবিলোশনে গড়ে ৯.০৩ পিপিএম জিংক পাওয়া গেছে।
এছাড়াও অন্যান্য প্রসাধনীর তুলনায় ভেষজ (হারবাল) প্রসাধনীগুলোতে দ্বিগুণ পরিমাণ টাইটেনিয়াম ও অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে। পরীক্ষিত ৮৬ শতাংশ ফেসওয়াশে অধিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম পাওয়া গেছে। যার গড় পরিমাণ ৭১৩ পিপিএম।
গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে আরো দেখা গেছে, পরীক্ষিত সব প্রসাধনী আর্সেনিক মিশ্রিত।
গবেষকরা জানান, ২০১৫ সালে ধানমন্ডির রাপা প্লাজা, চক বাজার, ঢাকার নিউ মার্কেটসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসডো ৩৩টি সর্বাধিক ব্যবহৃত জনপ্রিয় প্রসাধনী সক্রিয় করে। সব প্রসাধনীকে সাধারণভাবে ফেসওয়াশ, হারবাল ফেসপ্যাক, রং ফর্সাকারী ক্রিম, হেয়ারজেল (পুরুষ) এবং বেবিলোশন এই ৫ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
এই গবেষণায় উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশের ১০টি ফেসওয়াশ, দুটি হারবাল ফেস প্যাক, ১৬টি রং ফর্সাকারী ক্রিম, দুটি হেয়ারজেল এবং তিনটি বেবিলোশন পরীক্ষা করা হয়েছিল।
এসডো পরিচালিত এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল-‘‘প্রসাধনীতে ব্যবহৃত ভারি ধাতু ও বিষাক্ত কেমিক্যালের ঘনত্ব এবং সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করা।’’
প্রেস ব্রিফিং এসডোর চেয়ারপারসন সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, পরীক্ষিত নমুনায়, বিউটিলোশনগুলোতে অন্তত ৩ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ সর্বোচ্চ পরিমাণে পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন এসব প্রসাধনী ব্যবহার করলে ত্বকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরীক্ষিত প্রসাধনীগুলোতে পাওয়া বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
গবেষণা উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবু জাফর মাহমুদ।
কেনো গ্রাহকদের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত প্রসাধনী বর্জন করা উচিৎ এবং ওইসব রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা তিনি তুলে ধরেন।
ইউএনইপি’র মার্কারি বিশেষজ্ঞ ড. শাহরিয়ার হোসেন এবং এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা প্রসাধনীতে সর্বাধিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার সীমিত রাখার আইন কার্যকর করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন।
গবেষণাটিতে সরকার, সংশ্লিষ্ট এজেন্সি, প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদনকারী, আমদানিকারক ও ক্রেতাদের জন্য কিছু সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে-
১. সব উৎপাদনকারীর জন্য সঠিক পরিমাণের সমতায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে
২. বিএসটিআই’র বেবি এবং হারবাল সামগ্রীর জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড কার্যকর করা দরকার (প্রকাশিত এ গবেষণা অনুযায়ী অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর চেয়ে বেবি ও হারবাল সামগ্রীতে অধিক ভারি ধাতু বিদ্যমান)
৩. করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়ানো।
৪. ক্রেতাদের সব ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী ক্রয়ের পূর্বে সমতায়ন পরীক্ষা করতে হবে।
৫. ক্রেতাদের সব ধরনের কেমিক্যাল ও কৃত্রিম প্রসাধনী সামগ্রী বর্জন করতে হবে।