
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে শিল্প প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপের বিরুদ্ধে।
আবুল খায়ের গ্রুপের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী (আনসার) ও স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা সশস্ত্র অবস্থায় দলবলসহ গিয়ে সেখানে বসবাসরত ত্রিপুরাদের বিভিন্ন ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও তাদেরকে সেখান থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার হুমকি দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া পাড়াটিকে কাঁটা তার দিয়ে ঘিরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের চেষ্টাও তারা অব্যাহত রেখেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
আবুল খায়ের গ্রুপসহ স্থানীয় ভূমিদস্যুদের অত্যাচার ও হুমকি-ধমকিতে সেখানে ১৫০ বছরের অধিক সময় ধরে বসববাস করা ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা এখন অসহায় ও অনিরাদ হয়ে পড়েছেন।

বাসিন্দারা জানান, সীতাকুন্ড উপজেলার ত্রিপুরা পল্লীতে ৭৫টি দরিদ্র পরিবারের বাস। তাদের বসতি থেকে এক কিলোমিটার দূরে আবুল খায়ের গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বিশাল কারখানা। আবুল খায়ের গ্রুপ পল্লীর জায়গাটি তাদের দাবি করে বছর তিনেক আগে সাইনবোর্ড টানিয়ে সীমানা বেড়া নির্মাণ করতে গেলে ঝামেলা বাধে।
এরপর গত ১৪ মে শুক্রবার আবারো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে আবুল খায়ের গ্রুপ। তাদের বসতির উপর দিয়ে কাঁটা তারের বেড়া দিতে এলে বাসিন্দারা তাতে বাধা দেন। এসময় কারখানার সশস্ত্র আনসার ও স্থানীয় কতিপয় লোকজন মিলে অস্ত্র ঠেকিয়ে অসহায় ত্রিপুরাদের বসতি থেকে সরে না গেলে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দেয়।
ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দা কাঞ্চন কুমার ত্রিপুরা বলেন, আমরা এই পাড়ায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছি। জায়গাটি সরকারি পাহাড়ি ভূমি। কিন্তু আবুল খায়ের গ্রুপের লোকজন জায়গাটি তাদের বলে দাবি করছে। বিষয়টি আমরা সোনাইছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ও সীতাকুন্ড উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি।

সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহমেদ বলেন, ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দারা এ বিষয়ে আমার কাছে এসেছিল। তাদেরকে আমি উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিতে বলেছি। পাড়াটিতে অন্তত ৭৫টি পরিবার বসবাস করে। ওই পাড়ার বাসিন্দা সংখ্যা প্রায় ৪০০ জন।
আবুল খায়ের গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার ইমরুল কাদের ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ত্রিপুরা পাড়া থেকে ওই জমির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। হঠাৎ করে ঈদের দিন পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা মিলে আমাদের জায়গায় ঘর তৈরির চেষ্টা করে। পরে আনসার সদস্যদের নিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় কাজ বন্ধ করে দিই।
তিনি বলেন, যে জায়গায় ত্রিপুরারা ঘর তৈরি করছে, সেটি আমাদের কেনা জমি। আবুল খায়েরের নামে জমিটির নামজারি হয়েছে। সব ডকুমেন্ট আমাদের আছে। ইতোমধ্যে সব কাগজপত্র উপজেলা প্রশাসনকে দিয়েছি। জায়গাটি সরকারি হলে আমাদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকবে না।
সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায় বলেন, দু‘পক্ষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে বৈঠক হবে। জায়গার মালিক যদি আবুল খায়ের গ্রুপ হয়, তাহলে ত্রিপুরারা সেখানে ঘর করবে না। জায়গার মালিক সরকার হলে সেখানে ত্রিপুরারা ঘর করবে।
তবে এই ঘটনাকে উচ্ছেদ মানতে রাজি নন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায়। তার মতে আবুল খায়েরের দাবি করা জায়গাটিতে কোনো ত্রিপুরা বসতি নেই। মাপজোপ করার পর বলতে পারবো আসলে জায়গাটি কার। আমরা উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে বলেছি।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, আবুল খায়ের গ্রুপের পক্ষ নিয়ে কয়েক বছর আগে ইউএনও স্যার আমাদের জঙ্গল সলিমপুরে বস্তি এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য বলেছিল। জায়গাটি আমাদের পছন্দ হয়নি বলে যাইনি। আমরা আমাদের পুর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে যেতে চাই না। আমরা পাহাড়ে শান্তিতে বসবাস করতে চাই।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সীতাকুন্ড ইউনিটের মতে সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন পাহাড়ে বসবাসকারী প্রায় ৮০০ ত্রিপুরা পরিবার রয়েছে। এলাকাগুলো হচ্ছে বারৈয়ারঢারা ইউনিয়নের ছোট দারোগাহাট, সীতাকুণ্ড পৌরসদরের মহাদেবপুর, বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা ইউনিয়নের সুলতানা মন্দির ও ছোট কুমিরা, সোনাইছড়ি ইউনিয়নের মধ্য, দক্ষিণ সোনাইছড়ি ও মদনাহাট এলাকা।
এরমধ্যে দক্ষিণ সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায় ৭৫ পরিবার ছাড়াও সীতাকুন্ড উপজেলার ছোট কুমিরা ত্রিপুরা পাড়ায় ১২২ পরিবার, মহাদেবপুর ত্রিপুরা পাড়ায় ৪৫ পরিবার, ছোট দারোগাহাট ত্রিপুরা পাড়ায় ১০ পরিবার, সুলতানা মন্দির ত্রিপুরা পাড়ায় ৩০ পরিবার, বাঁশবাড়িয়া ত্রিপুরা পাড়ায় ১০ পরিবার, শীতলপুর ত্রিপুরা পাড়ায় ৩৮ পরিবার বাস করে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী এদেরকেও উচ্ছেদ করতে চায় বলে অভিযোগ রয়েছে।