ফন্ট সাইজ

শেয়ার করুন

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print

“রাউজানে কাজী দা”

সংবাদটি পড়তে সময় লাগবে ১২ মিনিট

শাম্মী তুলতুল

মুসলমানের ছেলে হয়ে হিন্দুদের নিয়ে লেখলেখির কারণে হিন্দুরা কবি নজরুল ইসলামকে “যবন” বা “অস্পৃশ্য” আখ্যা দেন। আর হিন্দু মেয়ে বিয়ে করা ও দেবদেবীদের নিয়ে লেখালেখির কারণে মুসলমানরা কবিকে “কাফের” বলেছিল।
নজরুলের সাহিত্য ও কবিতা পড়লেই বোঝা যায় তিনি উভয় সম্প্রদায় সম্পর্কে বেশ জ্ঞানী ছিলেন। তাইতো পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজকে জাগানোর উদ্দ্যেশ্যেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৩২ সালে রাউজানের তরুন কনফারেন্স, সাহিত্য ও শিক্ষা সম্মলেনে আনা হয়। এই কথাগুলো জানিয়েছেন তৎকালীন স্কুল ছাত্র ও প্রয়াত প্রবীণ শিক্ষাবিদ, কলামস্টি ,লেখক, বুদ্ধজিীবী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা,সমাজ সেবক,সংগঠক,ও নজরুল বন্ধু আলহাজ আব্দুল কুদ্দুস মাষ্টার। ১৯৩২ সালে যে তরুন সংঘের উদ্দ্যেগে কবি নজরুল ইসলাম রাউজান সফর করেছিলেন কুদ্দুস মাষ্টার ছিলেন সেই তরুন সংঘের অন্যতম নির্বাহী সদস্য ও সংগঠক। তরুণ কনফারন্সে কালে কুদ্দুস মাষ্টার ছিলেন রাউজান উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
কুদ্দুস মাষ্টার সেচ্ছাসেবক হিসেবে কবির সফর সঙ্গী ছিলেন সর্বক্ষন।
১৯৩২ সাল ছিল রাউজানবাসীর জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন ছিল। এই দিনে রাউজানে রায়মুকুট দিঘীর পূর্ব পার্শ্বস্থ বর্তমান পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর কমপ্লেক্সের ধানি জমির মাঠে তিনদিন ব্যাপী সাহিত্য ও শিক্ষা সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছিল। গড়ে তোলা হয় এক বিশাল প্যান্ডেল। এই প্যান্ডেল কোনো কাপড় কিংবা সামিয়ানা দিয়ে তৈরী ছিল না। বাঁশের খুটি, ছনের ছাউনি দিয়ে গড়া ছিল এই প্যান্ডেল। প্যান্ডেল তৈরীতে সময় লেগেছিল পুরো একমাস। পায়ে চলা কিংবা গরুর গাড়িতে বসা পথিক পূর্ব পার্শ্বে তাকিয়ে থমকে যান।
একি কান্ড ! এতো বিশাল ব্যাপার, কাজী দা কি সত্যিই আসবেন? সবার মনে উৎকণ্ঠা। আসবেন মানে, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই আসবেন। এ উত্তর বড় মিয়ার। এই বড় মিয়া হলেন মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম নুরুল আবছার চৌধুরী।
পরবর্তীতে এই স্কুলের উদ্যোক্তা ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মাষ্টারের বাবা মরহুম জমিদার হাজী ছাদন আলী এবং কুদ্দুস মাষ্টার। নুরুল আবছার চৌধুরী রাউজান সাহিত্য সম্মেলনেরও বাস্তবায়ন পরিষদের আহবায়ক ছিলেন।
১৯৩২ সালের শুরু থেকেই কবিকে সম্মেলনে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ লক্ষ্যে নুরুল হুদা চৌধুরী এবং রাউজানের আরো কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তি কবি নজরুলকে শিক্ষা সম্মেলন ও কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াতের চাঁদার জন্য রেঙ্গুনে যান। নুরুল হুদা চৌধুরী ছিলেন নুরুল আবসার চৌধুরীর অনুজ এবং তৎকালীন রাউজান তরুণ সংঘের সেক্রেটারী। তিনি রেঙ্গুনে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিক্ষানুরাগী, ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেন। চাঁদা উঠে তিন হাজার টাকা।
মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক নজির আহম্মদ চৌধুরী ও হাজী ছাদন আলীকে নিয়ে নুরুল হুদা চৌধুরী কলকাতায় শ্যামবাজারস্থ কবির বাসায় যান। কবি পত্নীর জন্য ৫ টাকা দামের একটি শাড়ী নিয়ে যান সাথে করে। নুরুল হুদা চৌধুরী কবিকে শাড়িটি ভাবীর জন্য এনেছি বলতেই কবি ‘হা-হা’ করে হেসে উঠেন। উদার মনের কবির সেই হাসিতে ঘরের ছাদ ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল সেদিন। কবি নির্দ্ধিধায় রাউজান আসার সম্মতি দিলে তাকে যাত্রা খরচ বাবদ দু’শত টাকা দেওয়া হয়। ফিরবার পথে দেওয়া হয় আরো দু’শত টাকা।
কবির চট্টগ্রামরে রাউজান সফর ১৯৩২ সালের ৫ ও ৬ মে বলেই ইতিপূর্বে বিভিন্ন লেখায় বলা হলেও আবদুল কুদ্দুস মাস্টারের মতে, কবি এসেছিলেন ১৯৩২ সালের ১৯ ও ২০ মে। পরের দিন ২১ মে চলে যান।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।হাটহাজারী থেকে ঘেরা নৌকা করে হালদা নদী পার হয়ে নজরুল রাউজানে প্রবেশ করলেন। শত শত উৎসাহী যুবক, কিশোর কাজী দা কে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানালেন। তখনকার রাউজানবাসী কবি নজরুলকে কাজী দা বলেই ডাকতেন। ঘোড়া গাড়ি করে কবিকে মোহাম্মদপুরের হাজ্বী ছাদন আলীর বাড়ী নিয়ে আসা হয়।
কবিকে প্রথম দিন মোহাম্মদপুর গ্রামের জমিদার ছাদন আলীর বাড়ীতে রাখার হয় কিন্তু পরবর্তীতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য হাজ্বী বাড়ির কাঁচারী ঘরটি নির্ধারণ করা হয়। প্রথম দিন ছাদন আলীর বাড়িতে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে রাতে চলে যান কবি হাজী বাড়িতে।
কাজী দা সাথে করে নিয়ে আসলেন তার নিত্য সঙ্গী হারমোনিয়াম এবং মুরালী বাঁশি। অনেকে জানেন না কবি অসম্ভব সুন্দর বাঁশী বাদক ছিলেন।
যে বাঁশীর সুর শুনে বালক কুদ্দুস বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে থাকতেন। কবি যে কক্ষে অবস্থান করছিলেন অর্থাৎ হাজ্বী বাড়ীর দক্ষিণে সেখানে ২০/২৫ টি সুপারি গাছ ছিল। কবি যখন নিরিবিলি সময়ে ছিলেন তখন তিনি বাঁশি বাজাতেন আর মনে মনে কবিতা লিখতেন। ‘গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটি সম্ভবত তখন লিখেছিলেন কবি। নজরুলের বাবড়ি কাটা ঝাঁকানো কালো চুল, টানা টানা দুটি বড় বড় চোখ, মায়াবী চেহেরা এবং দ্বরাজ কণ্ঠের অট্টহাসি কোনদিন ভূলে যাওয়ার না।
রাউজান সফরে নজরুলের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবী, ধুতী ও সাদা গান্ধী টুপী। পায়ে ছিল পাম্প-সু। ধুতীকে “তৎকালীন হিন্দুয়ানী পোষাক বলত কেউ কেউ। তখন ধুতীর প্রচলনও বেশি ছিল। কুদ্দুস মাস্টার’ এর মতে, তখন তিনি বা তারা রাউজানে ধুতী পড়তেন। আর পাম্প-সু ছিল তখনকার অভিজাত শ্রেণীর ব্যবহার্য।
প্রথম দিনেই কবিকে বড় কাপে গরম চা আর গরম গরম চিতল পিঠা এবং মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে আপ্যায়ন করা হল। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই কবির অট্ট হাসি। যে হাসিতে ছিল এক আন্তরিকতা, উদারতা। সে হাসির মাধ্যমে যেন কাজী দা রাউজান বাসীকে হƒদয়ের গহীনে বরণ করে নিলেন।
প্রথম দিন ছিল শিক্ষা সম্মিলনীতে শিক্ষা সম্পর্কে উদ্বোধনী ভাষন দেন ফটিকছড়ির বক্তপুরের কৃতী সন্তান শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মোমেনের সভাপতিত্বে শিক্ষা সম্মীলনীতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মাওলানা মনিরুজ্জামান,জমদিার হাজী ছাদন আলী, আবুল কাশেম সাবজজ, নুরুল আবছার চৌধুরী, ফটিকছড়ির আদালত খান, গহিরার আহম্মদ ছগির চৌধুরী। প্রথম দিন দুপুরের আহার শেষে আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। আলোচনা শেষে বিকাল ৪ টার পর কবি তার কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন।
অতঃপর সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগাড়ে ইসলামিক গান গেয়ে যান। গানের আসর শেষে রাতে ভাত খান মোহাম্মদপুরের হাজ্বী বাড়ীতে। দু’দিনেই কবিকে গরুর মাংস ও ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। কবিকে দু’দিন খাবার-দাবার দেওয়া হয় হাজ্বী বাড়ী ও ছাদন আলীর বাড়ী থেকে। কবির বাড়তি কোন চাহিদা ছিল না। তখন কোর্মা-পোলাও ও বিরিয়ানি দেওয়া হয় নাই। এসবের প্রচলনও তখন কম ছিল। শতরঞ্জি বিছিয়ে কবি ভাত খান। সব খাবারের মধ্যে কবির বেশি পছন্দ ছিল বালক কুদ্দুস এর মা (ওমদা খাতুন) -এর হাতের তৈরী চাক্তায়ের সুটকীর তরকারী। কবিকে হাত ধোয়ার জন্য চিলমসি দেওয়া হলে তিনি তা ঠেলে দিয়ে নিজেই গ্লাসে পানি ঢেলে প্লেটে হাত ধৌত করলেন। খাবার শেষে তিনি বক্সির হাঁটের পান মুখে পুরে দিতে ভুলে যাননি। পান চিবোতে চিবোতে অনর্গল ধারায় কথা বলেন। আর মাঝে মাঝে অট্টহাসি হাসেন। সে রাতেও চা ও পান খেতে খেতে রাত ১ টা পর্যন্ত ইসলামিক গান গেয়ে যান।
তবে কুদ্দুস মাস্টার এর ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়, কবি নাস্তা পানির চেয়ে ‘চা’ বেশি পছন্দ করতেন। কারণ কবি ১০/১২ বারের ওপর চা খেতেন।
কবি রাতে ঘুমান হাজ্বী বাড়ীর দক্ষিণ কামড়ায়। কবির পাশের কামড়ায় থাকতেন বালক কুদ্দুস। পরের দিন পূর্ব দিগন্তের সোনালি সূর্যদয়ের রক্তিম আভা ছড়ানোর সাথে সাথে কবি শয্যা ত্যাগ করলেন। আর কুদ্দুস মাস্টারকে ইশারায় কাছে ডেকে কবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছোকরা তোমার পুরো নাম কি’?
উত্তরে বালক কুদ্দুস বলল, আব্দুল কুদ্দুস’।
‘খুব সুন্দর নামতো।
কোন ক্লাসে পড়’,
বালক বললেন- ষষ্ঠ শ্রেণীতে।
কবি আবার বলে উঠলেন, নজরুলরে গান শুনছেো?
বালক বলল- জী, অনেক শুনেছি। আপনিইতো সেই নজরুল। সেখানেও নজরুলের অট্টহাসি। কবি বললেন, তোমার বাবার কাছেও আমি তোমার অনেক কথা শুনেছি । নজরুল আরো জানতে চাইলেন তোমাদের এখানে ফলগু নদী আছে?
বালক কুদ্দুস এইকথা না বুঝে কবির মুখের দিকে হা করে তাকিয়েছিলেন।
কবি আবার বোঝালেন, মরাগাঙ্গ চিনো হে বালক? পানি বিহীন নদী।
এইবার বালক কুদ্দুস বুঝতে পারলো কবি খাল খুঁজছনে। তখন কুদ্দুস বলল ঐ তো দেখা যায় পশ্চিমে একটি মরা খাল।
নজরুল জল গামছা কাঁধে নিয়ে বের হলেন ঘর থেকে। কবি হাজ্বী বাড়ীর কাঁচা টয়লেট বাদ দিয়ে বাড়ীটির সামনে ‘কাসখালী খালে’ প্রাকৃতিক কাজ সারেন। একদম মাটির মানুষ ছিলেন কবি।প্রাকৃতিক কাজ সেরে কুদ্দুসকে বললেন বাবু ওটা কি?
কুদ্দুস বলল ওটা রায়মুকুট দীঘি।
কবি বললেন, চলো দু’জনে দীঘির জলে সাঁতার কাটি। কথামতো দীঘির স্বচ্ছ জলে মন ভরে উদোম গায়ে অনেকক্ষন সাঁতার কেটে আনন্দ পেলেন কবি। দিঘীর ঘাটে বসে খালি গায়ে সাবান মেখে গোসল করলেন কবি। গোসলের পর কবির এলোমেলো চুলগুলো তার দৈহিক সৌন্দর্য্য দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর সকালের নাস্তা সারলেন কবি। সকালের নাস্তার মেনুতে ছিল চর্বিযুক্ত গরুর মাংস, রুটি, পিঠা, হাতে বানানো আরো অনকে নাস্তা। কবি অকৃপনতায় গলাধঃকরণ করলেন।
সকালের নাস্তা সেরে বেলা ১০ টা বাজার সাথে সাথে কবি সাদা ধপধপে পাঞ্জাবী কাধে হলুদ আলোয়ান পরে পায়ে হেঁটে সম্মেলনস্থলে এগিয়ে যাচ্ছেন। আর দু’দিক হাতে পুষ্প বৃষ্টি বর্ষিত হতে লাগল। কবির পিছনে অজস্র মিছিল আর করতালি, এর মধ্য দিয়ে কবি মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। সাথে অন্যান্য অতিথিবৃন্দও ছিলেন।
২য় দিন ছিল তরুণ কনফারেন্স। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর উদ্বোধনী ভাষন দিতে গিয়ে কবি হারমোনিয়াম টেনে নিলেন, মুর্হুমুহু হাততালির সাথে সাথে কবি গেয়ে উঠলেন- “বাজল কিরে ভোরের সানাই নিদমহলের আঁধার পুরে। শুনছি আজান গগনতলে, অতীত রাতের মিনার চুড়ে। আজ কি আবার কাবার পথে ভিড় জমেছে প্রভাত হতে। নামল কি ফের হাজার শ্রোতে ‘হেরার’ জ্যোতি জগৎ জুড়ে।’’
আর নারী কবিতাটি কবি গানের পাশাপাশি আবৃত্তি করেন এবং সেদিন রাতেও গানে, কবিতায় নিমগ্ন ছিলেন কবি। ১৯৩২ সালে নজরুল ইসলাম যখন রাউজান আসনে তখন চালের আরি (১৬ সের) এর মূল্য ছিল এক টাকা।
তাই সে সময়টায়ও নজরুলের আগমনে নজরুলকে দেখতে দর্শনীয় মূল্য দেয় লোকজন আট আনা, ১ টাকা করে।
১৯২৯/৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সম্মিলনীর আয়োজক প্রতিষ্ঠান তরুণ সংঘটি। রাউজানের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সাহিত্য চর্চার লক্ষ্যে এটির প্রতিষ্ঠা করা। তৎকালীন শিক্ষা-দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা মোহাম্মদপুরের অধিবাসীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সেখানে শিক্ষা সম্মেলন তরুণ কনফারেন্সটির আয়োজন করা হয়। তাইতো নজরুল আসার পর মোহাম্মদপুরের লোকজনের মধ্যে সেই সময়ও শিক্ষা সচেতনতা আরো অধিকতর বৃদ্ধি পায়।
কবি রাউজান সফর শেষ করার পর মোহাম্মদপুর প্রাইমারী স্কুলটি হাইস্কুলে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া চলে। তরুণ সংঘের শতাধিক সাধারণ সভা ছিলো। ১১ সদস্যের একটা কমিটি ছিল। তার মধ্যে নুরুল আবসার ছাড়াও অন্যরা হলেন মোহাম্মদপুরের ডাঃ নুরুল হক চৌধুরী, নুরুলহ হক বি.এল, মোহাম্মদ মিয়া, ডাঃ দুদু মিয়া চৌধুরী, অলিমিয়া চৌধুরী, জমদিার হাজী ছাদন, বদিউর রহমান সওদাগর, মাস্টার আহমেদ মিয়া চৌধুরী। এরা সকলেই এখন প্রয়াত।
কবি নজরুলের সান্নিধ্য আবদুল কুদ্দুস মাস্টারকে এতই বেশি প্রভাবিত করেছিল যে, নজরুলকে তিনি দু’বার স্বপ্নে দেখেন। প্রথমবার দেখেন, নজরুল যাওয়ার পর যেনো কবি বলছেন- কুদ্দুস আমাকে চা দাও।কুদ্দুস চলো দিঘীতে গোসল করি।
আরেকবার স্বপ্ন দেখেন, হজ্ব থেকে ফিরে এসে ১৯৯০ সালে। খুব ছোটবেলা থেকে বালক কুদ্দুস নজরুলের গান শুনতে অভ্যস্থ। তার বাবার গ্রামোফোনে নজরুলরে গান শুনতেন। সেই থেকেই কবির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন বালক কুদ্দুস।
১৯৩২ সালে কুদ্দুস মাস্টার তার সেই গীতিকার কবি নজরুল ইসলামকে কাছে পান। রাউজানে তরুণ কনফারেন্সে নজরুলের গাওয়া ‘ভোরের সানাই’ গানটি কুদ্দুস মাস্টারের মনে নাড়া দিত সব সময়।
কুদ্দুস মাস্টার ও কবি নজরুল ছিলেন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁরা দুজন , দু’রাত তিনদিন বন্ধুর মতই ছিলেন। কবির কথাবার্তা ছিল খুবই নমনীয়। ছোটদের সাথে কথা বলার ধরণই ছিল তাঁর আলাদা। মায়াবী এই নিরহংকারী ব্যক্তি নজরুল ছোটদের সাথে মিষ্টি সুরে ও সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। যার প্রমান বালক কুদ্দুস।তাছাড়া বিভিন্ন লেখক ও গবেষকদের লেখায়ও কবিকে ঘিরে কুদ্দুস মাস্টারে স্মৃতিময়তা ঠাঁই পায়।
তৃতীয় দিন ছিল নজরুলের বিদায় বেলা। সকালে প্রায় ২০০ জন লোক পাঁয়ে হেঁটে সত্তারঘাট পর্যন্ত তাঁকে দিয়ে আসেন। কবি যান টেক্সিতে করে। সেই সময় কার-টেক্সিতে ১০/১২ জন যাত্রী বসতে পারতেন। কবির সাথে বিদায় বেলায় টেক্সিতে ছিলেন বালক কুদ্দুস, আবুল কাশেম উকিল, হাজী ছাদন আলী, আহমদ ছগির চৌধুরী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী, নুরুল হুদা চৌধুরী, নুরুল আবছার চৌধুরী।
গহিরা স্কুলের সামনে যেতেই আহমদ ছগির চৌধুরী কবিকে নামিয়ে স্কুলটিতে নিয়ে যান। সেখানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি হারমোনিয়াম নিয়ে দাঁড়িয়ে চল-চল-চল গানটি পরিবেশন করেন। এরপর নজরুল বিদায় নেন। বিদায় নেওয়ার আগে বালক কুদ্দুসকে গাল টেনে কবি বললেন, ‘বিদায় বন্ধু’। আবার দখো হবে ।
নজরুলকে বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, রেঁনেসার কবি, মুসলিম পুনঃজাগরণের কবি ইত্যাদি অভিধায় সিক্ত করা হয়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে নজরুলের পরিচয় হয়ে ওঠে মানুষের কবি ও মানবতার কবি। মানুষের মর্যাদার পক্ষে, সমাজ-রাষ্ট্র বিশ্ব ব্যবস্থার পক্ষে নজরুল ‘চির উন্নত মম শির’।
আর আবদুল কুদ্দুস মাস্টার ছিলেন একাধারে কলামস্টি, লেখক ,শিক্ষাবিদ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা,বুদ্ধিজীবী, একজন গরীবের বন্ধু, সমাজসেবক।
আজ কবি নজরুল ইসলাম নেই, নেই কুদ্দুস মাস্টার। কিন্তু আজীবন বিশ্ববাসী এবং দেশরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে তাঁরা দু’জনের ইতিহাস।

লেখক: উপন্যাসিক ও সংগঠক

“পাঠকের কলাম” বিভাগের সকল সংবাদ, চিত্র পাঠকের একান্ত নিজস্ব মতামত, এই বিভাগে প্রকাশিত সকল সংবাদ পাঠক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। তা্ই এ বিভাগে প্রকাশিত কোন সংবাদের জন্য পাঠক.নিউজ কর্তৃপক্ষ কোনো ভাবেই দায়ী নয়।

সর্বশেষ

ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে চট্টগ্রামে বিআরটিএ’র বিশেষ অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা হয়নি: প্রেস সচিব

সিরিয়ার ঋণ শোধ করবে সৌদি-কাতার

ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ

প্রথম চুয়েটের রিফাত আল ইব্রাহিম ⦿কেএসআরএম অ্যাওয়ার্ড পেলেন তিন ভবিষ্যৎ স্থপতি

ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আগ বাড়িয়ে মধ্যস্থতা করতে চায় না বাংলাদেশঃ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সন্ধ্যায় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে প্রথমবারের মতো উড়াল দেবে কার্গো ফ্লাইট

Facebook
X
Skype
WhatsApp
OK
Digg
LinkedIn
Pinterest
Email
Print