
দেশের মূল ভুখ- থেকে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলা। এটি নির্বাচনী আসন চট্টগ্রাম ৩। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সন্দ্বীপেও চলছে নির্বাচনী গরম হাওয়া। উপজেলা আওয়ামীলীগ ও বিএপি নেতারা নিজেদের গুণকীর্তনে ব্যস্ত। একই সাথে বিরোধী দলের প্রতি একে অপরের বিষেদাগারও কম না।
এদিকে নিজেদের গুণকীর্তনে নিজেরা ব্যস্ত থাকায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি থেকে এমপি পদে মনোনোয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা প্রায় ডজনখানেক। ডজনখানেক নেতারা ভীড়ে দিশেহারা তাই সন্দ্বীপবাসী।
তারপরও সন্দ্বীপকে মূল ভূখন্ডে এনে নাগরিক জীবনের সব সুবিধা নিশ্চিত করাসহ সন্দ্বীপবাসীকে উন্নয়নের আলোয় আলোকিত করতে চান বর্তমান এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা। আর এ জন্যই আবারও আওয়ামীলীগ থেকে তিনি মনোনোয়ন প্রত্যাশী।
একই আসনের আওয়ামীলীগ থেকে মনোনোয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় আরো রয়েছেন সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বিএ এবং উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আকরাম খান দুলাল, পৌর চেয়ারম্যান জাফর উল্লাহ টিটু।
একই চিত্র রয়েছে বিএনপিতেও। সাবেক এমপি মোস্তাফা কামাল পাশা এবারও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চান। টানা তিনবার নির্বাচিত এই এমপি মনোনয়ন দৌড়ে দলেও এগিয়ে আছেন। তবে তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছেন অপর দুই মনোনয়ন প্রত্যাশী-দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল পাশা বাবুল ও কাতার প্রবাসী ব্যবসায়ী নুরুল মোস্তফা খোকন।
সন্দ্বীপের ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, সন্দ্বীপ দেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত উপজেলা। এটি একটি অত্যন্ত প্রাচীন দ্বীপ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের আয়তন ৩০ বর্গমাইলের হলেও ক্রমাগত নদী ভাঙ্গনের কারনে বর্তমানে এটি মাত্র ৮০ বর্গমাইলেল একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। এই দ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ।
চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে নদীপথে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এ উপজেলার অবস্থান। সন্দ্বীপের সীমানা হচ্ছে পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল, চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে সীতাকুন্ড উপজেলাও মীরসরাই উপজেলা, উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তার পশ্চিমে নোয়াখালী উজেলা ও দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর।
১৯৫৪ সালের পূর্ব পর্যšন্ত সন্দ্বীপ নোয়াখালী জেলার অন্তভূর্ক্ত থাকলেও পরবর্তিতে একে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে সন্দ্বীপ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। সন্দ্বীপে একটি পৌরসভা রয়েছে, যা ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। ৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় ইউনিয়ন রয়েছে প্রায় ১৪টি।
বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চল থেকে সন্দ্বীপ উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। মোট নৌপথ ২২ নটিক্যাল মাইল।
এটি চট্টগ্রাম জেলায় জাতীয় সংসদের ২৮০নং আসন। চট্টগ্রাম-৩ আসনটি চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলা নিয়ে গঠিত।
২০১৪ সালে আওয়ামীলীগ থেকে মাহফুজুর রহমান মিতা ১ লাখ ১১ হাজার ৭৪৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি থেকে এম,এ সালাম পেয়েছিলেন ৩ হাজার ৪ টি ভোট আর জাসদের নুরুল আক্তার পান ৮৭৪টি ভোট।
১৯৭৩ সালে মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৯ সালে বিএনপি থেকে একেএম রফিকউল্লাহ চৌধুরী, ১৯৮৬ সালৈ বিএনপি থেকে একেএম রফিকউল্লাহ চৌধুরী, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে একেএম শামসুল হুদা, ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগ থেকে মোস্তাফিজুর রহমান, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি থেকে মোস্তফা কামাল পাশা, ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামীলীগ থেকে মোস্তাফিজুর রহমান, ২০০১ সালে বিএনপি থেকে মোস্তফা কামাল পাশা, ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে মোস্তফা কামাল পাশা ও ২০১৪ সালে নির্বাচিত হন মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে মাহফুজুর রহমান মিতা সাংসদ নির্বাচিত হন।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনোয়ন প্রত্যাশী এই নেতা বলেন, সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর থেকে এলাকায় আমি উন্নয়নের মাইলফলক তৈরী করেছি। সন্দ্বীপের বড় সমস্যা ছিলো বিদ্যুৎ। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর সন্দ্বীপে দুটি শক্তিশালী জেনারেটর বসিয়ে ২ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়াও জাতীয় গ্রীড থেকে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এটির টেন্ডার শুরু হয়েছে। ২০১৮ সাল নাগাদ পুরো সন্দ্বীপ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরো বলেন, হাতিয়া, মহেশখালী, কৃতৃবদিয়া এাকার মধ্যে সন্দ্বীপকে এ পাইলট প্রজেক্টে সন্দ্বীপকে অন্তর্ভর্ক্ত করা হয়েছে তারই প্রচেষ্টায়। এছাড়াও বর্তমানে চলাচলের জন্য একটি নতুন ষ্টিমারের অনুমোদন হয়েছে। ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সন্দ্বীপে গুপ্তছড়া ঘাটে একটি জেটি স্থাপন করা হবে। এর আগে এ কাজ কেউ করেননি বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ টিম এসে এটি দেখে গেছে। জেটিটি স্থাপন হলে যাতায়াত অনেক আরামদায়ক হবে বলে জানান তিনি।
এছাড়াও সন্দ্বীপের চারদিকে ২১৩ কোটি ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মান করা হবে। এ প্রকল্পটি টেন্ডারের জন্য অনুমোদিত হয়েছে বলেও জানান তিনি। এমপি মিতা আরো বলেন, সন্দ্বীপের অবকাঠাম্গোত উন্নয়নে অনেক এগিয়ে রয়েছে। এ এলাকার রাস্তাঘাট অন্য কোন উপজেলার চেয়ে অনেক উন্নত।
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে এমপি আরো বলেন, সন্দ্বীপ সরকারি হাসপাতাল ৩১ শয্যা থেকে ৫১শয্যায় উন্নীত করা রহয়েছে। টেন্ডার শুরু হয়েছে। এছাড়াও ৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে সন্দ্বীপে। ১২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা করার পর্যায়ে রয়েছে। তার বাবার প্রতিষ্ঠিত মোস্তাফিজুর রহমান ডিগ্রী কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। এটি সন্দ্বীপের মতো প্রত্যন্ত একটি দ্বীপের শিক্ষার্থীদের জন্য বড় পাওয়া বলে জানান তিনি।
মনোনোয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে আগামীতে কি করবেন, এ প্রশ্নের উত্তরে এই সাংসদ জানান, আবারো নির্বাচিত হলে তিনি সন্দ্বীপকে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করার জন্য কাজ করবেন। সন্দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিশাল চর জেগে উঠেছে। তাই সন্দ্বীপ থেকে উরিরচর সড়ক নির্মান করলে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত হবে সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপ অনেক অনাবাদি জমি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এখানে ইকোনোমিক জোন করার প্রস্তাব গৃহিত হয়েছে। এখানে ইকোনোমিক জোন হলে এলাকার লোকদের কর্মসংস্থান হবে। সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে সন্দ্বীপ।
নানা উন্নয়নের মন্ত্রে বর্তমান এমপি মিতা মুগ্ধ হয়ে আবারো মনোনোয়ন প্রত্য্শাী হলেও তার সাথে মনোনোয়ন প্রত্যাশীর দলে আরো রয়েছেন সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বিএ এবং উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আকরাম খান দুলাল, পৌর চেয়ারম্যান জাফরউল্লাহ টিটু।
উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান মাস্টার শাহজাহান জানান, আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করি। আমি সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামীলীগের ৩৬ বছর ধরে সভাপতি। তার সুবাদেই তিনি সন্দ্বীপ থেকে মনোনোয়ন প্রত্যাশী। বর্তমান এমপি মিতার উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পূর্কে এই নেতা বলেন, এমপি হিসেবে তার জন্য যে বরাদ্দ থাকে, সেখান থেকেই তিনি কাজ করছেন। প্রত্যেকেরই ক্রুটি -বিচ্যুতি থাকে। তারও থাকতে পারে। তবে যার যাই থাকুক, তার ব্যক্তি ও দলীয় ইমেজে তিনি আওয়ামলিীগ থেকে আগামী নির্বাচনে লড়ার জন্য মনোনোয়ন প্রত্যাশী।
সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামীলীগের দলীয় নেতাকর্মী সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আছে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের। তারা দু’জন একমঞ্চে বসে দলীয় কর্মসূচি পালন করলেও বিরোধ মেটেনি। এ বিরোধে যুক্ত আছেন সন্দ্বীপ পৌর মেয়র জাফরুল্লাহ টিটুও।
সন্দ্বীপে আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে মোহাম্মদদ শাহজাহান বলেন, আমাদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবেই। কিন্তু সেটা কারো প্রতি কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করা কিংবা পিছু লাগা নয়।
মনোনোয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় থাকা আরেকজন পৌর মেয়র জাফরুল্লাহ টিটু বলেন, ২ বছর ধরে আওয়ামী রাজনীতি করছি। স্কুলে পড়ার সময় স্কুল ছাত্রলীগ কমিটির সাধারন সম্পাদক থেকে শুরু করে পৌর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হয়েছি। হয়েছেন উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের ক্রীড়া সম্পাদক। বর্তমানে পৌর মেয়র তিনি। দীর্ঘ রাজনীতি জীবনে কাজ করতে গিয়ে তিনি সন্দ্বীপবাসীর পাশে থেকেছেন। জাফরউল্লাহ টিটু আরো বলেন, আমি পৌরসভার মেয়র। পৌরসভা একটা ছোট সীমানা। তাই বড় পরিসরে মানুষের জন্য কাজ করতে সাংসদ হওয়ার ইচ্ছে পোষন করি। আর তাই আগামী নির্বাচনে সন্দ্বীপ থেকে আওয়ামীলীগ থেকে তিনি মনোনোয়ন প্রত্যাশী বলে জানান।
বর্তমান সাংসদ মিতার কর্মকান্ড নিয়ে এই নেতা আরো বলেন, সাংসদ সরকারী অনুদানে কাজ করছেন। তবে তার কাজে তেমন তো কোন কারিশম্যাটিক কিছু তিনি দেখেননি। সন্দ্বীপের যে সমস্যা আগেও ছিলো, তা এখনো আছে। তবে দলীয় কোন্দল ও দ্বন্দ্ব অস্বীকার করে জাফরউল্লাহ টিটু বলেন, আমাদের মধ্যে কোন দ্বন্দা¦ নেই। তবে প্রতিযোগীতা আছে। আর তা যেকোন বড় দলে তা থাকবেই।
তবে সন্দ্বীপের উন্নয়ন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রার্থীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বিএনপি নেতারা। বিএপির অভিযোগ, উন্নয়নের নামে এখানে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কোটি টাকার দূর্নীতি হয়েছে। দূর্নীতির কারনে নৌপদ নিরাপদ হয়নি। সরকারি দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন ডজনখানেক নেতা।
আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, সন্দ্বীপ এখন এক ভীতিকর জনপদের নাম। গত নয় বছরে এখানে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে এবার বিএনপি নির্বাচনে গেলে ধানের শীষের জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
তবে মোস্তফা কামাল পাশাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আটঘাট বেঁধে মাঠে আছেন দলেরই অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী মোস্তফা কামাল পাশা বাবুল। বছরের বেশিরভাগ সময় আমেরিকা থাকলেও তার ধ্যান-জ্ঞানে আছে সন্দ্বীপ বলে জানান তিনি। এ জন্য স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ সন্দ্বীপের বিভিন্ন উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
নুরুল মোস্তফা খোকন বলেন, তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। সন্দ্বীপবাসীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি অতীতে কাজ করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন।
এদিকে জাতীয় পার্টির এম এ সালাম স্বপ্ন দেখছেন আগামী সংসদ নির্বাচনে দল থেকে তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিবেন। কারন তিনি মনে করেন সন্দ্বীপের মানুষের সাথে তার আত্মার সম্পূর্ক।