
জীবন মুছা,চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম মহানগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে কেনা হয়েছে সাড়ে তিনকাঠা জায়গা। ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের একটি নকশা সিডিএতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সাতকানিয়া রাস্তার মাথায় কেনা হয়েছে ৪০ শতক জমি। একইভাবে গ্রামের বাড়ি কাঞ্চনায় কেনা হয়েছে একশ কানি নাল ও ফসলি জমি। আর প্রায় বড় একটি পুকুর কেনা হয় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে।
শুধু তাই নয়, নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারে চালু করেছেন হামীম ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি। দেড়কোটি টাকায় কিনেছেন ২টি বিলাসবহুল ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি। নগরের মেহেদী বাগে ১৫ কাঠা জমি। গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ার কাঞ্চনায় প্রায় দুই কানি জমির উপর বহুতল ভবনের কাজ শুরু করেছেন ছয় মাস আগে। ইতিমধ্যে ভবনের তৃতীয় তলার ছাঁদ ঢালাই দেয়া হয়েছে এই রমজানের আগে। ভবনটি ১০তলা ফাই-েশনে উঠবে ৭ তলা পর্যন্ত। এছাড়া রয়েছে প্রায় ২০টি মাইক্রো। তবে এসবের মূলে মো. টিপু প্রকাশ কানা টিপু, মো. খোরশেদ, মো. জাহেদ ও নূর মোহাম্মদ এ চার ভাই আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার এক গল্প।

টিপুদের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কাঞ্চনা ইউনিয়নে। ওই গ্রামের দরিদ্র নুরুল ইসলামের পরিবারে জন্ম তাদের চার ভাই ও এক বোনের। কিশোর বয়সে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি টিপু ও জাহেদ। অটোরিক্সা ট্যাক্সি চালক হয়ে যান দুজন। অপর দুই ভাই খোরশেদ এবং নূর মোহাম্মদকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেও তাদের পড়া- লেখা হয়নি। স্থানীয় বাজারে দু‘ভাই ছোট্ট একটা দোকান নিয়ে শুরু করেন ভিডিও দোকানদারী। তবে এ চারজনের উপার্জনের মধ্যেও সাত সদস্যের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
তবে ২০০৬ সালের শেষের দিকে সুযোগ পেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত দুবাই শহরে পাড়ি দেন টিপু। এরপর একে একে চার ভাই ঠিকানা হয় দুবাই। সেই থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়তি তাদের। অল্পদিনে দেশের মধ্যে অঢেল বিত্ত-ভৈববের মালিক। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ায় আছে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। আছে একাধিক বাড়ি ও গাড়ি। প্রতিমাসেই চার ভাই ৩-৪ বার দুবাই থেকে দেশে আসে। দেশে আভ্যন্তরীণ চলাচলের সময় বিমান ব্যবহার করেই চলাচল করেন তারা।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, এই চার ভাইকে স্থানীয়রা ব্যবসায়ী হিসেবে জানলেও এর আড়ালে মূলত তারা সোনা চোরাকারবারী। ২০১৫ সালে আটক হওয়া বিমানের এক কর্মকর্তার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এসেছে জাহেদ-টিপুর নাম। এদিকে সোনা চোরাচালানে জড়িত ৩০টি চক্রের সন্ধানও পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার মধ্যে টিপু-জাহেদদের একটি গ্রুপ।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১৮অক্টোবর সিলেট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাড়ে ৭ কেজি সোনাসহ আটক হন সাতকানিয়ার কাঞ্চনা ইউনিয়নের আব্দুল গফুর মেম্বারের ছেলে আবদুল লতিফসহ পাঁচজন। আটকের পর তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। সে সময় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে আড়াল করে স্বীকারোক্তি দিলেও ওই ৭ কেজি সোনা পাচারের জাহেদ জড়িত থাকার বিষয়টি গোয়েন্দাদের নিশ্চিত করেছেন লতিফ। সেই থেকে সিলেট কারাগারে বন্দি রয়েছে আবদুল লতিফ।
আবদুল লতিফের ভগ্নিপতি শামসুল আলম জানান, সাড়ে সাত কেজি স্বর্ণের মালিক আবদুল লতিফ নন। সেই দিন ত্রিশ হাজার টাকা চুক্তিতে স্বর্ণগুলো লতিফ বহন করে দেশে আনে। তবে বিমান বন্দর ক্রস করতেই ধরে পড়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে। তবে জামিনে বেড়িয়ে এসে আবার বিদেশে পাড়ি দিযেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিপুর এক নিকট আত্মীয় বলেন, স্থানীয় বাজারে সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন টিপু ও জাহেদ। সংসারে তারা চারভাই। অন্য দুই ভাই ওই বাজারেই একটি অডিও-ভিডিও দোকান করতেন। দোকনটি পুড়ে যাওয়ার পর দুবাই পাড়ি দেয় টিপু। তার হাত ধরে জাহেদ। পর্যায়ক্রমে তার অপর দু‘ভাইও চলে যায় সেখানে।
সাতকানিয়ার কাঞ্চনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রমজান আলী বলেন, টিপুর পিতা ব্যাংকে চাকুরী করতেন। মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। টিপুদেও পারিবারিক অবস্থা এক সময় খুবই খারাপ ছিল। পড়া লেখা তেমন না করলেও দুবাই গিয়ে তাদেও হঠাৎ পরিবর্তন দেখা যায়। বর্তমানে এলাকায় দান খয়রাত করে বলেও তিনি জানান। স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়ে তিনি বলেন,আমিও শুনেছি তাদের দুবাইতে স্বণের দোকান আছে। মধ্য কাঞ্চনার লতিফ নামে এক যুবক একবার সিলেট গ্রেফতার হওয়ার পর টিপুর নাম শুনা যায় স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়ে।
সিলেট বিমান বন্ধরে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে আটক হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে লতিফ পুলিশকে জানায়, দুবাই গিয়ে টিপু ও জাহেদের পরিচয় ঘটে সোনা চোরাকারবারীদের সাথে। একসময় নিজেই গড়ে তোলেন একটি সিন্ডিকেট। শুল্ক বিভাগ, সিভিল এভিয়েশেন ও বিমানের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে টিপু, জাহেদ এবং তার ভাইয়েরা প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো ফ্লাইটে সোনার চালান নিয়ে দেশে আসছেন। তবে নিজেরা বহন করেন না কোনো সোনার চালান। বাহক আছে একাধিক। কিন্তু নিয়মিত নিজস্ব বাহকদের মধ্যে জোবায়ের, রহিম, জাফর, ইরফানসহ ১৪-১৫ জনের একটি গ্রুপ আছে। যারা বেতন ভূক্ত ও ব্যবসায়িক পার্টনার।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, টিপু ও জাহেদের দলে থাকা তার সহযোগীরা মোবাইল ফোনে সিম ব্যবহার করেন না। হোয়াইটসআফ বা ইমুতে যোগাযোগ হয় তাদের। একটি চারান নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে গেলে পাল্টে যায় ব্যবহুত হাতের মোবাইলও। অতিঅল্প সময়ে সোনা পাচারে কোটিপতি বনেছেন জড়িত টিপু ও জাহেদরা। এখন শত কোটি টাকার মালিত তারা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর সিলেট শাহজালালে বিমানবন্দরে ধরা পড়া ৭ কেজি সোনার চালানের সাথে দুবাই থেকে দেশে আসে জাহেদ। ওই সময় শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে সোনাবহনকারী লতিফ আটক হতেই সটকে পড়ে জাহেদ। এরপর কলকাতায় গিয়ে গা ঢাকা দেয় কিছু দিনের জন্য। এর রেশ কাটতে না কাটতে ওই বছরই ৪ নভেম্বর সিলেট শাহজালাল বিমান বন্দরে ১০ কেজি সোনার আরেকটি চালান ধরা পড়ে। আর এই চালানের একদিন আগে দেশে আসা টিপু ওই দিনই চট্টগ্রাম শাহ আমানক বিমান বন্দর হয়ে দুবাই চলে যায়। তবে এর পর থেকে আর তামতে হয়নি এক বারের জন্যও। সোনার চালান নিরাপদেই দেশে আসে তার গ্রুপের সদস্যদের মাধ্যমে। টিপু-জাহেদের বাবা নুরুল ইসলাম ওমরা ভিসায় সৌদি আরব গিয়ে অবস্থান করছেন গত এক মাস ধরে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে দেড় বছর আগে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নেয় আবদুল লতিফের ছোট ভাই ইরফান। এর পর পরই দুবাই নেয় যায় তাকে।
সি.এম.পি পতেঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কাশেম ভুঁইয়া বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে সাতকানিয়ার জাহেদ নামক এক যুবক জড়িত থাকার খবর আমরা পেয়েছি। তবে এ বিষয়ে ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগ থেকে এখনও অফিসিয়ালি কিছু পাওয়া যায়নি।
গত দু বছর আগে সোনা চোরাচালানে জড়িত ৩০টি চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর মধ্যে ২৩টি দেশে থেকে ও সাতটি বিদেশে থেকে তৎপরতা চালায়। দেশীয় ২৩টি চক্রের মধ্যে ১১টি সরাসরি এবং ১২টি চক্র মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির আড়ালে সোনা চোরাচালান করছে। ১১ চক্রের মধ্যে ঢাকায় সাতটি, চট্টগ্রামে তিনটি ও সিলেটে একটি চক্র রয়েছে।
বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্র জানায়, ২০১৭ সাল থেকে এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সোনা আটকের ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় মামলা হয়েছে ৭টি। গেফতার হয়েছেন ৭ জন। এর মধ্যে সোনার ১৪টি বার, ১২টি চেইন, ২টি চুড়ি, সোনার ১২টি রিংসহ গ্রেফতার করা হয় একজনকে। এই ঘটনায় আটক ব্যক্তিকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে নগরের পতেঙ্গা থানায়। একই ভাবে গত বছর ৪ অক্টোবর সোনার ১২টি বার নিয়ে গ্রেফতার করা হয় একজন। ৭ অক্টোবর সোনার ১২টি বার নিয়ে গ্রেফতার করা হয় একজন।
একই বছর ২৮ নভেম্বর সোনার ৭টি বার নিয়ে গ্রেফতার করা হয় একজন। ২২ নভেম্বর সোনার তিনটি চুড়ি ও ১৪টি বার নিয়ে গ্রেফতার করা হয় একজন। চলতি বছর ১৪ মার্চ ১০টি সোনার বার নিয়ে গ্রেফতার হয় একজন। সর্বশেষ ৩ এপ্রিল সোনার ২৪টি বার, ৪টি চুড়ি (১২ কেজি ৯‘শ গ্রাম)সহ গ্রেফতার হয় একজন। তবে এর মধ্যে বিমানের টয়লেট থেকে পরিত্যক্তবস্থায় জব্দ হয়েছে বেশ কয়েকটি সোনার চালান।
এদিকে টিপুর বক্তব্য জানার জন্য বার বার চেষ্টা করেও তার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। জানাগেছে টিপু বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন।